ইসলামিক যুগে বা মধ্যযুগে নারী শিক্ষা
ইসলাম ধর্মে মহিলাদের শিক্ষা গ্রহণে কোন বাধা ছিল না, কিন্তু ওই সময় আমরা দেখতে পাই যে নারী শিক্ষা একটি প্রতিকূল অবস্থার ভিতর দিয়ে চলেছিল। পর্দাপ্রথার দরুন একটি বয়সের পর মেয়েদের বিদ্যালয়ে গিয়ে শিক্ষালাভের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। কঠোর ধর্মীয় অনুশাসন, পর্দা প্রথা এবং নানা ধরনের সামাজিক শৃঙ্খলের দরুন সাধারণ মেয়েদের পক্ষে শিক্ষার আলো পাওয়া সম্ভব ছিল না। অল্পবয়সে বিবাহ, সন্তান পালন ও অন্তঃপুরবাসী জীবনযাত্রার ক্ষেত্রে সমসাময়িক অন্যান্য ধর্মাবলম্বী মেয়েদের সঙ্গে তাদের মৌলিক পার্থক্য বিশেষ কিছু ছিল না! তবে ধনী ও অভিজাত পরিবার, এবং নবাব পরিবারগুলিতে মেয়েরা ইসলামিক ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ করত। অনেক সময় হারেমগুলিতেও ধর্মীয় শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা হত এই সব মেয়েদের জন্য।
বেশ কিছু শিক্ষিতা নারীদের আমরা সেই সময় দেখতে পাই যেমন ফতিমা, সোফিয়া, মারিয়াম, আয়েষা, জায়েনাব ইত্যাদি। সুলতানা রাজিয়া খুব শিক্ষিতা ছিলেন। বাবরের মেয়ে গুলবদন বেগম “হুমায়ুন নামা” নামক জীবন চরিত লিখেছিলেন এবং তাঁর নিজের একটি গ্রন্থাগারও ছিল যাতে প্রচুর বইয়ের সম্ভার ছিল। বাবরের আর এক নাতনি গুলরুখ খুবই প্রতিভাবতী সাহিত্যিক ছিলেন। তিনি “মুফি” নামক ছদ্মনাম ব্যবহার করতেন। আকবরের নিজের মা হামিদাবানুও পণ্ডিত ছিলেন। আকবরের স९ মা মোহম্ আনাগা শুধু যে বিদূষী ছিলেন তা নয়, তিনি একটি উচ্চ বিদ্যালয় স্থাপনও করেছিলেন। জাহাঙ্গীর পত্নী নূরজাহান আরবি এবং ফারসি সাহিত্যে সুপণ্ডিত ছিলেন এবং নিয়মিত সাহিত্য চর্চাও করতেন। শাহজাহানের স্ত্রী মমতাজ বেগম ফারসি ভাষার সুদক্ষ ছিলেন এবং কবিতা রচনা করতেন। শাহজাহানের বড়ো মেয়ে জাহানরা বেগম দুটি জীবনী লিখেছিলেন। নিজের সমাধির ওপর খোদিত স্মৃতিগাথাটিও তাঁর স্বরচিত। জাহানারার শিক্ষিকা ছিলেন এক বিদগ্ধ নারী সুফাউন্নিসা। তাঁর প্রভাবেই মমতাজ বেগম দরিদ্র মেয়েদের শিক্ষা ও উন্নয়নের জন্য নানা রকম অনুদানের ব্যবস্থা করেছিলেন। ঔরঙ্গজেবের কন্যারা সকলেই বেশ শিক্ষিতা ছিলেন। তাঁর জ্যেষ্ঠা কন্যা জিবুন্নেষা ফারসি এবং আরবিতে সুদক্ষ ছিলেন। তাছাড়াও তিনি লিপি কৌশল বিদ্যাতেও পারদর্শী ছিলেন। তাঁর আরো দুই কন্যা বদবুন্নেসা এবং জিনাতুন্নেসা কোরান মুখস্থ করেছিলেন এবং স্মৃতি থেকে পাঠ করতে পারতেন।
সুলতান জালালুদ্দিন এবং আকবর মেয়েদের জন্য “জেনানা” বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সুলতান গিয়াসুদ্দীন তাঁর হারেমের মহিলাদের জন্য মহিলা শিক্ষিকা নিয়োগ করেছিলেন।
অভিজাত বংশের মেয়েদের মধ্যে ইসলামিক শিক্ষার কিছুটা প্রচলন থাকলেও এবং আকবর প্রমুখ উদার শাসকরা হিন্দুদের শিক্ষার কিছুটা পৃষ্ঠপোষকতা করলেও মধ্যযুগে হিন্দু নারীদের শিক্ষার অবনতি অব্যাহত ছিল। কারণ রাজকীয় সাহায্য ও পৃষ্ঠপোষকতা ছিল সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। যদিও ধনী পরিবারগুলিতে তখনও কিছু মেয়েদের শিক্ষার প্রচলন দেখা যায়। মীরবাঈ এবং চন্দ্রাবতীর কবি ছিলেন। রানি দুর্গাবতীও সুপণ্ডিত ছিলেন। এই সময় আমরা চাঁদবিবি নামে বিদুষী ও বীরাঙ্গনা মহিলারও উল্লেখ পাই।
সমসাময়িক সাহিত্য থেকে আমরা তখনকার নামী শিক্ষা সম্বন্ধে বেশ কিছুটা ধারণা পাই। “ইচ্ছাবতী হরণ”, “ধর্মমঙ্গল কাব্য”, “ধর্মমঙ্গল”, “বিদ্যাসুন্দর” “কবি কঙ্কন রচিত চন্ডীমঙ্গল” ইত্যাদি থেকে আমরা জানতে পারি যে মেয়েরা তখনও নৃত্য ও সঙ্গীতকলা চর্চা করত এবং নারী শিক্ষার একটি বহুল প্রচলিত গণমাধ্যম ছিল যাত্রা, কথকতা, নানা ধরনের মৌখিকভাবে প্রচারিত লোক সাহিত্য, গীতি কবিতা ইত্যাদি। কিন্তু সাধারণভাবে মুসলিম সংস্কৃতি থেকে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বজায় অজুহাতে মেয়েদের শিক্ষা নানা সংস্কার ও কুসংস্কারের নীচে প্রায় সম্পূর্ণভাবে চাপা পড়ে যায় এই সময়ে।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .