বিবাহ বিচ্ছেদ
বিবাহ প্রতিটি সমাজের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান। বিবাহের মাধ্যমে সংসারের ও সমাজের ধারা সংরক্ষিত হয়। বিবাহ সূত্রে আবদ্ধ স্ত্রী ও পুরুষ উভয়েই এবং তাদের আত্মীয় স্বজন ও সমাজের অন্যান্য লোক—সবাই আশা করে যে এই সম্পর্ক যেন স্থায়ী হয়। কিন্তু নানান কারণে এই সম্পর্কের মধ্যে ফাটল ধরে, স্বামী স্ত্রীর মধ্যে মনোমালিন্য দেখা দেয় এবং অনেক ক্ষেত্রে বৈবাহিক সম্বন্ধের অবসান ঘটে।
বিবাহ বিচ্ছেদ বলতে বুঝায় রাষ্ট্রীয় আইনের দ্বারা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বৈধ বৈবাহিক সম্বন্ধ ছিন্ন করে পৃথকভাবে বসবাস করে। বর্তমানে বিবাহ বিচ্ছেদ সারা বিশ্বে ব্যাপক হারে দেখা যাচ্ছে। এই বিবাহ বিচ্ছেদ স্বয়ং যেমন একটি সমস্যা, তেমনি এ থেকে বহু পারিবারিক ও সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি হয়। কোন্ কোন্ কারণ থেকে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে তা সঠিক না বলা গেলেও কতকগুলি বিষয় বা ঘটনা বিবাহ-বিচ্ছেদের অনুকূল আবহাওয়া সৃষ্টি করে।
প্রথমত,
ধর্মীয় বাধা নিষেধ শিথিল হয়ে পড়লে বিবাহ বিচ্ছেদের প্রবণতা দেখা দিতে পারে। মুসলমান বা খৃষ্টীয় সমাজের তুলনায় হিন্দু সমাজে এখনও বিবাহ বিচ্ছেদের সংখ্যা অনেক কম, কারণ হিন্দু সমাজে বিবাহ বন্ধনের পিছনে শাস্ত্রীয় ও বৈদিক অনুমোদন আছে। বিবাহ বন্ধনকে পবিত্র বলে মনে করা হয়। আবার হিন্দু সমাজে গ্রামের তুলনায় শহরে বিবাহ বিচ্ছেদের সংখ্যা বেশী, কারণ শহরের লোকেদের উপর পাশ্চাত্যের প্রভাব বেশী পড়েছে।
দ্বিতীয়ত,
স্বামীর ও স্ত্রীর পরিবারের মধ্যে জীবনধারা ও পদমর্যাদার পার্থক্য বেশীহলে বিবাহ-বিচ্ছেদের সম্ভাবনা দেখা দেয়। জমিদার পরিবারের পুত্র বা কন্যার সাথে একজন সাধারণ কেরানির পরিবারের কন্যা বা পুত্রের বিবাহ হলে উভয়ের মধ্যে মনোমালিন্য ও শেষ পর্যন্ত বিচ্ছেদ ঘটতে পারে।
তৃতীয়ত,
আজকাল সমাজের মানুষের গতিশলীতা.(mobility) বৃদ্ধির জন্য স্ত্রী ও পুরুষ উভয়েই স্বামী বা স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্কের বাইরে তাদের যৌন কামনা তৃপ্ত করতে কুণ্ঠিত নয়। আজকাল শিক্ষিত ও অর্থবান স্ত্রী ও পুরুষ উভয়ই একরাত হোটেলে গিয়ে বা পার্বত্য অঞ্চলে বেড়াতে গিয়ে অবৈধ যৌন সংসর্গ করে নতুনত্বের স্বাদ পাবার চেষ্টা করে। এর পরিণাম হয় বিষময় এবং একারণে বৈধ বিবাহের উপর চাপ পড়ে এবং শেষ পর্যন্ত বিবাব বিচ্ছেদ ঘটায়। বিবাহ বন্ধনের বাইরে যৌন সুখ সম্ভোগ করা, যেটি আজকাল বিশেষ বৃদ্ধি পেয়েছে, প্রায়ই বিবাহ বিচ্ছেদের কারণ হয়। বিবাহ বিচ্ছেদের আর একটি কারণ হল দেশে শিল্প ও বাণিজ্য প্রসার লাভ করার বহু লোককে ঘর সংসার ছেড়ে চাকরি বা ব্যবসায়ের খাতিরে অন্যত্র গিয়ে বাস করতে হয়। এর ফলে স্বামী ও স্ত্রী মধ্যে বন্ধন শিথিল হয়ে পড়ে এবং শেষ পর্যন্ত বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটাতে পারে। এছাড়া আজকে আইনগত ভাবে নারীদের অনেকগুলি অধিকার দেওয়া হয়েছে যেগুলি পূর্বে তাদের ছিল না। বধূ নির্যাতনের অভিযোগ পুলিশের কাছে করলে পুলিশ তৎক্ষণাৎ অভিযুক্ত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করবে। এই আইনটির প্রয়োজন আছে নিশ্চয়, কিন্তু বহু ক্ষেত্রে এই আইনের অপব্যবহার হচ্ছে। নিরপরাধ স্বামীর নামে এই অভিযোগ দায়ের করলে সে গ্রেপ্তার হবে এবং কিছুদিন পুলিশের হাতে অযথা নিগৃহীত হবে। এর ফলে পারিবারিক বন্ধন শিথিল হয়ে যাবে।
বিবাহ বিচ্ছেদের আর একটি কারণ হল আজকাল অনেক মহিলা অর্থোপার্জন করছে এবং ফলে তাদের মধ্যে নিজেদের অধিকার সম্বন্ধে সচেতনতা অতিমাত্রায় বেড়ে গেছে। বিবাহে যে কত স্বার্থত্যাগ করার প্রয়োজন তা তারা বিস্মৃত হয় এবং পুত্রকন্যাদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কেও তারা ভাবে না। এই বিকৃত অহংবোধ বিবাহ বিচ্ছেদের অন্যতম কারণ। এই ব্যাপারটি আজ পাশ্চাত্য জগতে কুৎসিত ভাবে প্রকট হয়ে উঠেছে এবং আমাদের দেশেও এই রোগ দেখা দিতে শুরু হয়েছে। এই জাতীয় স্ত্রী-পুরুষদের নিকট বিবাহ ব্যবস্থা এক প্রকার যৌন সংসর্গে পরিণত হয়েছে। এরা ব্যক্তিগত সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের ঊর্দ্ধে কোন কিছুর কথা চিন্তা করতে পারে না। এদের কাছে বিবাহ যেন অন্তহীন মধুচন্দ্ৰ, যেই মধুর মাত্রা কমে গেল তৎক্ষণাৎ তাদের মধ্যে ঘটে যায় বিচ্ছেদ।
মুসলমান সমাজে বিবাহ বিচ্ছেদ খুব সহজ। তিনবার ‘তালাক’ শব্দটি উচ্চারণ করে (এমনকি টেলিফোনে) স্বামী স্ত্রীকে বিদায় করে দিতে পারে। এই অধিকার অবশ্য স্ত্রীর নেই। এছাড়া, চার বিবির ব্যবস্থা থাকলে বিবাহে সবসময়ে স্ত্রীকে সন্ত্রস্ত হয়ে থাকতে হয়। সনাতন ধর্মে বৈদিক যুগ থেকে নারীকে উপযুক্ত মর্যাদা দিয়ে আনা হয়েছে। সেই প্রভাব এখনও বেশ খানিকটা আছে এবং সে কারণে হিন্দু সমাজে বিবাহ বিচ্ছেদের সংখ্যা এখনও মুসলমান ও খৃষ্টীয় সমাজের তুলনায় কম। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে আদর্শ, সম্বন্ধ বাস্তব জগতে আশা করা শক্ত। কিন্তু বহু ঘাত প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে বিবাহ বন্ধনকে সার্থক করে তোলাই স্ত্রী ও পুরুষ উভয়েরই কর্তব্য। সমস্যার সমাধান করার পরিবর্তে বিবাহ বিচ্ছেদ প্রকৃত সমস্যাটিকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা।
বর্তমানে যেসব বিষয় সমাজ ও পরিবারের ঐক্য শিথিল করে সমাজে বহু সমস্যার সৃষ্টি করছে তার মধ্যে রয়েছে বিবাহ বিচ্ছেদ। আজ খুব কম লোকই বিবাহ বন্ধনকে আত্মিক ও চিরস্থায়ী বন্ধন বলে মনে করে। অন্যান্য অস্থায়ী সম্পর্কের (যথা ভাড়া বাড়ীতে থাকা) মত বিবাহ সম্পর্কও অস্থায়ী। সুতরাং কোন অসুবিধা ঘটলে আমরা অনায়াসে এই বন্ধছেদ করতে পারি (একটি বাড়ী ছেড়ে অন্য বাড়ীতে গিয়ে বাস করতে পারি) ও অন্য নারীর সাথে নতুন বন্ধন স্থাপন করতে পারি। প্রাচীন রোমে চারিত্রিক ও নৈতিক অধঃপতন চরমে গিয়ে পৌঁছেছিল। ধনী লোকেদের সম্বন্ধে বলা হত – They marry to divorce and divorce to marry । এইভাবে প্রাচীন রোম ধ্বংসের পথে এগিয়ে আসল। দু-একটি ক্ষেত্রে বিচ্ছেদ বাঞ্ছনীয় হলেও ব্যাপক ভাবে বিবাহ বিচ্ছেদ নিঃসন্দেহে একটি সামাজিক রোগের চিহ্ন।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .