বিবাহ এবং বিবাহ বিচ্ছেদ
বিংশ শতাব্দী ফ্রান্সে সিমন দ্য বোভোয়ার ছিলেন (Simone de Beauvoir) একজন চরমপন্থী বুদ্ধিজীবী ও নারীবাদী (feminist) আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ। তিনি ফরাসী দার্শনিক জাঁ পল সার্ত্রের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ না হয়েও স্বামী-স্ত্রীর মত জীবন যাপন করে গেছেন। এ হেন মহিলা যে বিবাহ বন্ধনে বিশ্বাস করবেন না তা বলা বাহুল্য। বিবাহ ও বিবাহ-বিচ্ছেদ সম্পর্কে তাঁর মত এই যে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীরা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে তাদের মান মর্যাদা আত্মসম্মান হারায় এবং প্রকৃতপক্ষে দাসীবৃত্তি গ্রহণ করে। নারীর স্বাধীনতা বিলুপ্তির অন্যতম পরিকল্পনা হল বিবাহ ব্যবস্থা। বিবাহিত জীবনে বিভিন্ন প্রকারের বিধি নিষেধ আরোপ করে স্ত্রীলোকদের স্বাধীনতা হরণ করা হয় এবং পুরুষদের নিকট আত্মসমর্পণ করতে তাদের বাধ্য করা হয়। যেহেতু বিবাহ বন্ধন নারীদের স্বাধীনতা হরণ করে তাদের ক্রীতদাসে পরিণত করে সেজন্য’ প্রচলিত বিবাহ ব্যবস্থার অবসান ঘটানো দরকার। বোভোয়ার যদি বলতেন যে চাকরি চাকুরীজীবীর স্বাধীনতা হরণ করে, মালিকের দাসে পরিণত করে, সুতরাং চাকরি-বাকরির অবসান ঘটানো দরকার, সবাই ব্যবসা বাণিজ্য করুক তাহলে প্রত্যেকের স্বাধীনতা বজায় থাকবে, তাহলে তার মস্তিষ্কের সুস্থতা সম্পর্কে অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করত। কিন্তু বিবাহ সম্পর্কে তার উদ্ভট মতের জন্য তাকে বুদ্ধিজীবী বলে অনেকে মনে করেন। প্রকৃতপক্ষে বোভোয়ার এবং সার্ত্র যে জীবন যাপন করে গেছেন তা ধ্বংসাত্মক এবং সমাজের স্থিতিশীলতার পরিপন্থী।
এটি অনস্বীকার্য যে আজও অনেক সমাজে মহিলার প্রতি অন্যায় আচরণ ধর্মের দোহাই দিয়ে সমর্থন করা হচ্ছে। মুসলমান সমাজে একজন পুরুষ চারটি বিবাহ করতে পারে, কিন্তু মহিলাদের এ অধিকার দেওয়া হয়নি। পুরুষেরা তিনবার ‘তালাক’ শব্দ উচ্চারণ করে স্ত্রীকে বিদায় দিতে পারে, কিন্তু মহিলাদের এ অধিকার নেই। মহিলাদের আপাদ মস্তক তাঁবুর মত একটি জিনিষে (বোরখা) ঢেকে থাকতে হয়; কিন্তু এই বোরখা পরার ব্যবস্থা পুরুষদের মধ্যে নেই। খৃষ্ট ধর্মানুযায়ী স্বামী যদি স্ত্রীর বিরুদ্ধে শুধুমাত্র ব্যভিচারের অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেন তাহলেই স্বামী স্ত্রীকে বিদায় দিতে পারবে, কিন্তু একজন স্ত্রীর পক্ষে স্বামীর বিরুদ্ধে ব্যভিচারের অভিযোগ প্রমাণ করা যথেষ্ট নয়, আরও কিছু প্রমাণ করতে হবে। মুসলমান সম্প্রদায়ে যদি কোন মহিলা পরিবারের বা সমাজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোন কাজ করে, সে কাজ যদি আদৌ অন্যায় কাজ না হয় তাহলেও তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় এবং এই বর্বর হত্যাকাণ্ডকে honour killing নাম দেওয়া হয়েছে। এখানে honour যে কোথায় তা ধর্মান্ধ মুসলমান পুরুষরাই জানে। পাশ্চাত্য জগতে অবশ্য স্ত্রীলোকদের অধিকারের অগ্রগতি অনেক হয়েছে, তবুও স্ত্রী-পুরুষের মধ্যে যে সমপর্যায়ের তা এখনও বলা যায় না।
সমাজ জীবনে স্ত্রীপুরুষ অনেক বৈষম্য আছে। বিবাহ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অনেক ত্রুটি আছে কিন্তু সেজন্য বিবাহ ব্যবস্থার উচ্ছেদের যে দাবী নারীবাদীগণ করেছেন তা হাস্যকর। মোটরগাড়ী ও অন্যান্য যানবাহনে মাঝে-মাঝে দুর্ঘটনা ঘটে, লোক মারা যায়, কিন্তু এর প্রতিকার কি যানবাহন উচ্ছেদ করা? বোভোয়ার এইরকম হাস্যকর কথা বলেছেন, কিন্তু তার প্রলাপোক্তি শুনে বুদ্ধিজীবীগণ মুগ্ধ। তিনি যে সমাজের মূলোচ্ছেদ করবার ব্যবস্থা করেছেন, এ অভিযোগ তার বিরুদ্ধে কেউ করেনি।
মার্ক্সীয়গণ মনে করেন অর্থনৈতিক স্বাধীনতা থাকলে স্ত্রীলোকগণ অন্যান্য সকল প্রকার স্বাধীনতা, এমন কি বিবাহ জগতেও, স্বাধীনতা ভোগ করবে। যদিও অর্থনৈতিক অধিকার স্ত্রীদের অধিকারকে শক্তিশালী করবে, তবুও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা মানুষকে স্বর্গরাজ্যে নিয়ে যেতে পারবে না। একজন অর্থনৈতিক দিক থেকে স্বাধীন ও মুক্ত মহিলা বহুপ্রকার সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে এবং হয়েও থাকে। সে যদি বোভোয়ার পন্থীদের মত একক জীবন যাপন করে তাহলে তার সুখ-দুঃখের ভাগী কেউ থাকবে না। তবুও আধুনিক নারীবাদীগণ বাহবা দেবে এই তথাকথিত স্বাধীন মহিলাটিকে। আসলে সে যে নিরানন্দ নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করছে একথা এই স্বল্পবুদ্ধি নারীবাদীগণ ভুলে যান।
বিংশ শতাব্দী ফ্রান্সে নারীবাদী আন্দোলনের নেত্রী বোভোয়ার মনে করতেন যে বিবাহ ব্যবস্থা নারীদেরকে পুরুষের দাসে পরিণত করে। নারীরা তাদের স্বাধীনতা হারায়। এই অবস্থা অবসানের জন্য বিবাহ বিচ্ছেদ প্রয়োজন। বলা বাহুল্য এই মত কোন দিক থেকেই স্বীকার করা যায় না। সমাজে এবং পরিবারে স্ত্রী-পুরুষের ঐক্য একান্ত প্রয়োজন। স্বয়ং প্রকৃতিদেবী যেন ‘এই ব্যবস্থা করেছে মনুষ্য সমাজের ধারা ও ঐক্য বজায় রাখার জন্য। বোভেয়ারের মত গ্রহণ করলে সমাজ ও পরিবার ধ্বংস হয়ে যাবে, তার সাথে ধ্বংস হবে নারীবাদী আন্দোলন।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .