নারীশিক্ষার অর্থ ও ধারণা
যে-কোনো রাষ্ট্র বা দেশের উন্নতিতে নারী এবং পুরুষ উভয়ের গুরুত্বপূর্ণ অবদান থাকে। একটি দেশের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক থাকে নারী। আর সেই নারী যদি অবহেলিত হয় তাহলে সেই দেশের সার্বিক উন্নতি কখনোই সম্ভব নয়। কারণ একটি পরিবারে একজন মহিলা দক্ষতার সঙ্গে তার দায়িত্ব পালন করতে না পারলে সেই পরিবারের তথা সমাজের উন্নতির অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। মহিলারাই তাদের শিশুদের সুন্দরভাবে গড়ে তোলার মধ্যে দিয়ে ভবিষ্যতে দেশকে অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির পথে নিয়ে যেতে সাহায্য করে। তার জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত শিক্ষা, যে শিক্ষার মধ্য দিয়ে সে তার কর্মকুশলতাকে বৃদ্ধি করতে পারে। শিক্ষিত মহিলারা যেমন নিজের পরিবারকে সংস্কৃতির দিক থেকে উন্নত করতে পারে, তেমনি সমাজকেও উন্নতির পথে নিয়ে যেতে সাহায্য করে। তাই নারী শিক্ষাকে প্রতিটি দেশের বা সমাজের গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা প্রয়োজন।
আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলিতে নারী শিক্ষা ব্যতিরেকে শিক্ষা সম্পূর্ণ করা যাবে না। আর শিক্ষার সার্বজনীনতার ওপর যদি গুরুত্ব আরোপ করতে হয় তাহলে নারী শিক্ষাকে বাস্তবায়িত করতে হবে। ভারতীয় সংবিধান নারী-পুরুষের সমান অধিকার স্বীকার করা হয়েছে। বর্তমানে নারী প্রগতির ব্যাপারটি আজ আর উত্তেজিত নয়। নারী শিক্ষার বর্তনাম অবস্থা জানার আগে কোনো কোনো সময়ে নারী শিক্ষার অবস্থা কেমন ছিল তা একটু জেনে নেওয়া প্রয়োজন।
প্রাচীন ভারতে নারী শিক্ষা
প্রাচীন ভারতে শিক্ষার অবস্থা পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে বৈদিক সমাজে নারীদের স্থান ছিল অতি উচ্চে। নারীদের বেদ পাঠে। অধিকার ছিল এবং তারা যাগযজ্ঞে অংশগ্রহণ করত। গুরুগৃহে বসবাস করে বেদ অধ্যয়ন করতে পারত। বৈদিক যুগের অনেক নারী মন্ত্রদ্রষ্টাও ছিলেন। যেমন—বিশ্ববরা, ঘোষা, লোপামুদ্রা, অপালা প্রমুখ।
মহাকাব্যের যুগেও নারীদের শিক্ষা ও জ্ঞানকে যথেষ্ট মর্যাদা দেওয়া হত। রামায়ণে কৌশল্যা ও তারাকে মন্ত্রবিদ আখ্যা দেওয়া হয়েছে। মহাভারতে দ্রৌপদীকে মণ্ডিতা বলা হয়েছে। উপনিষদে উল্লেখ আছে নারীগণ ব্রহ্ম সম্পৰ্কীয় আলোচনায় বা বিতর্কে অংশগ্রহণ করতেন। প্রাচীনভারতে নারীগণ অধ্যাপনাও করতেন। একটু লক্ষ করলে দেখা যায় যে বৈদিক যুগের সূচনা কাল থেকে উপনিষদ ও মহাকাব্যের কাল পর্যন্ত ভারতীয় সমাজে নারীদের শিক্ষায় তেমন ব্যাঘাত ঘটেনি।
কিন্তু সূত্রযুগে রক্ষণশীলতার কারণে মেয়েদের স্বাধীনতা অনেকাংশে লুপ্ত হয়। নানা কারণে নারীদের শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হয়। চালু হয় বাল্যবিবাহ, ফলে অল্প বয়স থেকেই অন্তঃপুরে আবদ্ধ হতে বাধ্য হয়। মনুসংহিতায় উল্লেখিত বিধানে দেওয়া আছে নারীর বাল্যে পিতার, যৌবনে পতির, বার্ধক্যে পুত্রের অধীনে থাকবে। এ থেকে বোঝা যায় যে নারী স্বাধীনতা অনেকাংশে খর্ব হতে থাকে।
বৌদ্ধ যুগের প্রথম দিকে নারীর স্থান ছিল গৌণ। বৌদ্ধবিহারে নারীর স্থান ছিল না। পরবর্তীকালে গৌতমী ও প্রিয় শিষ্য আনন্দের আগ্রহে বৌদ্ধ শিক্ষায় নারীর অধিকার স্বীকৃত হয়। যদিও বহুবিধ বিধিনিষেধ মেনে তাদের লেখাপড়া শিখতে হত। এই সময়ের গুণী মহিলারা হলেন—শ্রমণী, সরবী, আম্রপালী, সুপ্রিয়া প্রমুখ।
মধ্যযুগে নারী শিক্ষা
মধ্যযুগে মুসলিম রাজত্বকালে পদাপ্রথা চালু হওয়ার কারণে মুসলিম নারীর গতানুগতিক বা আনুষ্ঠানিক শিক্ষালাভে বঞ্চিত হয়। আবার অন্য দিকে হিন্দুরা জাত-ধর্ম নষ্ট হওয়ায় ভয়ে নারীদের গৃহ-পরিবেশে সংরক্ষণ করতে বাধ্য হয়। দেশের সাধারণ অবস্থা নারী শিক্ষা সম্প্রসারণের সহায়ক ছিল না। তবে বিত্তবান হিন্দু-মুসলমানগণ বাড়িতে মেয়েরা শিক্ষার ব্যবস্থা করতেন।
মিশনারি প্রচেষ্টায় নারী শিক্ষা
মিশনারিদের প্রচেষ্টায় উনিশ শতকের প্রথমার্ধে বেশ কিছু নারী শিক্ষার প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। বাংলার যে সমস্ত মেয়েদের শিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলি ছিল তার মধ্যে ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে রেভারেও যে চুঁচুড়ায় মেয়েদের লেখাপড়া শেখানোর জন্য একটি স্কুল খোলেন। পরের বছর উইলিয়াম কেরি শ্রীরামপুরের একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। শ্রীরামপুর মিশনের উদ্যোগে মেয়েদের শিক্ষার জন্য Female Juvenile Society স্থাপিত হয় যারা ১০টি বিদ্যালয় পরিচালনা করত। পরবর্তীকালে এই সোসাইটির নাম পরিবর্তিত হয়ে Calcutta Baptist Fmeale School Society রাখা হয়। মিশনারি উদ্যোগে ইংল্যান্ড থেকে কুমারী কুককে নিয়ে আসা হয় শিক্ষা পরিচালনার জন্য। তিনি চার্চ মিশনারি সোসাইটির আর্থিক সাহায্যে কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে মেয়েদের জন্য কয়েকটি অবৈতনিক স্কুল খোলেন। ১৮২৪ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে কুমারী কুক প্রতিষ্ঠা করেন ২৪টি বিদ্যালয়। এই বিদ্যালয়গুলিতে পড়া, লেখা ও গণিত শেখানোর সাথে সাথে ইতিহাস, ভূগোল প্রভৃতি বিষয় শেখানো হত। বাংলার নারী শিক্ষা বিকাশে কুমারী কুকের গুরুত্ব অপরিসীম।
এইরূপ মাদ্রাজ, বোম্বাই প্রভৃতি অন্যান্য প্রদেশেও মহিলা মিশনারিদের উদ্যোগে মেয়েদের বিদ্যালয় স্থাপিত হয়। ১৮২১ খ্রিস্টাব্দে চার্চ মিশনারি সোসাইটি মাদ্রাজে প্রথম মেয়েদের বিদ্যালয় স্থাপন করেন। ১৮২৪ খ্রিস্টাব্দে বোম্বাই প্রদেশে প্রথমে মেয়েদের বিদ্যালয় স্থাপন হয়। তাছাড়াও দেখা যায় মিশনারিদের উদ্যোগে ভারতের নানা জায়গাতে অনাথ আশ্রম, কর্মাশ্রম প্রভৃতি খোলা হয়।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .