বর্তমানের সমাজব্যবস্থায় পিতৃতন্ত্র মতবাদের বিভিন্ন দিক
পূর্বে পিতৃতন্ত্র বলতে সাধারণভাবে বোঝানো হত এক বৃহৎ পরিবারকে যার সর্বময় কর্তৃত্ব পিতা বা পিতাতুল্য কোন পুরুষের হাতে ন্যাস্ত। তবে বর্তমানে নারীর উপর পুরুষের কর্তৃত্ব টিকিয়ে রাখবার যে সামাজিকক পন্থা তাকেই পিতৃতন্ত্র হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এক্ষেত্রে কিন্তু পুরুষের কর্তৃত্ব বলতে কিছু পাষন্ড পুরুষের স্বেচ্ছাচার এবং অধীনতা বলতে কিছু হতভাগ্য নারীর বশ্যতাকে বোঝানো হচ্ছে না। পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এর একটি প্রতিষ্ঠানিক মাত্রা রয়েছে এবং এই বিষয়টি পরিস্কার হয়ে যায় যদি আমরা অর্থনৈতিক, ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলির এই বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পর্যবেক্ষণ করি।
প্রথমেই বলতে হয় পরিবারের কথা। সামাজিক মৌলিক একক হিসেবে হয়ত। পরিবারই সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। পরিবারই প্রাথমিকভাবে বাড়ির ছেলেমেয়েদের গতিশীলতা, শ্রম, প্রজনন, যৌন চাহিদা— এই সমস্ত কিছুকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। পরিবারই প্রাথমিকভাবে সামাজিকীকরণের ক্ষেত্র। বর্তমানে বহু তথাকথিত শিক্ষিত পরিবারে আমরা আপাতভাবে ছেলে এবং মেয়েকে শিক্ষার সমান সুযোগ পেতে দেখি। এথেকে আমাদের ভ্রম হওয়া সম্ভব যে পিতৃতান্ত্রিক মতবাদ সামাজিক ভাবে ক্ষীণ হয়ে এসেছে। কিন্তু যা অনেক সময়েই আমাদের চোখ এড়িয়ে পেছনে প্রচ্ছন্নভাবে এমন দ্বিবিধ আদর্শকে চারিয়ে দেওয়া হয় যা নারী-পুরুষের অসম ক্ষমতার সম্পর্ককে সম্পূর্ণভাবে টিকিয়ে রাখে।
ধর্মের দিকে তাকালেও আমরা দেখতে পাই যে বেশিরভাগ ধর্মই পুরুষতান্ত্রিক এবং পুরুষের কর্তৃত্বকে চুড়ান্ত হিসাবে ধরে নিতে শিখায়। আইন ব্যবস্থার ক্ষেত্রে আজও বহুদেশেই পুরুষতন্ত্রের দাপট পরিস্কার। যেমন, দক্ষিণ এশিয়ার বহু দেশই আইনিব্যবস্থা পুরুষকে গৃহকর্তা এবং শিশুর স্বাভাবিক অভিভাবক বলে মনে করে এবং সম্পত্তির আইনি উত্তরাধিকারী হিসেবে মেনে নিয়েছে। কিন্তু আইন যেহেতু কার্যকরি করে মানুষ সেহেতু আইনি মনোভাবে পিতৃতন্ত্রের ছাপ থেকেই যায়।
অর্থনীতিতে পুরুষের আধিপত্য কীভাবে বজায় থাকে তা কমবেশি আমরা সকলেই জানি। উৎপাদনশীল কাজের চিহ্নিতকরণ এবং তার মূল্যমান নির্ধারণে এই পিতৃতান্ত্রিক মতাদর্শরই প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায়। মারিয়া সীমের মতে, ‘ছায়ার মতো কাজ করে মেয়েরা উদ্বৃত্ত সৃষ্টিতে যে ভূমিকা পালন করে তা শ্রম হিসাবে গণ্যই হয়না। তাছাড়া, সন্তানের জন্ম ও প্রতিপালনকে শ্রম হিসেবে গণ্য করা হয় না এবং অর্থনৈতিক মূল্যায়ণও হয় না।
বর্তমানের পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা হল লিঙ্গ রাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। লিঙ্গ বৈষম্যের শুরু ও তার বিকাশ পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ঘটে। তাই লিঙ্গ বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে ‘লিঙ্গ রাজনীতিরও বিকাশ ঘটতে থাকে। অর্থাৎ পিতৃতান্ত্রিক সমাজে পুরুষের প্রাধান্যই নারীদের জীবনযাপন করতে হয়। পুরুষ ও তার পৌরুষের দ্বারা নারীকে দমিয়ে রাখে। সমাজে পিতার বংশধররাই পরিচিতি লাভ করে।
পরিশেষে বলা যায় সর্বদিক বিচার করে দেখা যায় পিতৃতন্ত্র সমাজের এক বৃহত্তর অবস্থান রয়েছে। তবুও বলা যায় পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নারীজাতিত পুরুষের আধিপত্যের বিরুদ্ধে তাদের মর্যাদা ও অধিকার আদায়ের দাবিতে আন্দোলন করে আসছে। এবং পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নিজেদের ভারসাম্য বজায় রেখেছে।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .