Register Now

Login

Lost Password

Lost your password? Please enter your email address. You will receive a link and will create a new password via email.

Captcha Click on image to update the captcha .

Add question

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর যৌথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা সফল হয়েছিল কি?

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর যৌথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা সফল হয়েছিল কি?

যৌথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ ধ্বংসলীলা মানুষকে আন্তরিকভাবে শান্তিকামী করে তােলে। প্যারিস শান্তি-সম্মেলনে সমবেত রাষ্ট্রনায়কগণ মার্কিন রাষ্ট্রপতি উড্রো উলিসনের চৌদ্দ-দফা শর্তের’ চতুর্দশ শর্তে বর্ণিত আন্তর্জাতিক সংস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পৃথিবীতে স্থায়ী শান্তি ও নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে উদ্যোগী হন। যে-কোন প্রকার যুদ্ধের নিরসন দ্বারা রাষ্ট্রের উন্নয়নে ব্রতী হওয়ার রাষ্ট্রীয় কর্তব্যকে বাস্তবায়িত করার প্রেরণা বিভিন্ন রাষ্ট্রের নেতৃবৃন্দের মনে দৃঢ়মূল হয়। এমন মানসিক রূপান্তরের পরিপ্রেক্ষিতে লীগ অব নেশন্স-এর নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিধানের উদ্যোগ শুরু হয়।

যৌথ নিরাপত্তার সংজ্ঞা

বিশ্বে প্রতিটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র নিজ নিজ নিরাপত্তা ও অখণ্ডতা রক্ষার ব্যবস্থাদি করে। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ঘটনাবলী প্রমাণ করে দেয় যে, কেবল একক প্রয়াসে নিজ নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা সর্বদা সম্ভব হয় না। এখন অনুভূত হয় যে, এককভাবে নয়—মিলিতভাবে যদি শান্তিস্থাপনে ও নিরাপত্তাবিধানে রাষ্ট্রগুলি উদ্যোগী হয়, তবেই তা সম্ভব হবে এবং সহজসাধ্যও হবে। অর্থাৎ যৌথ-নিরাপত্তা ব্যবস্থার মূলধারণা হল এই যে, পৃথিবীর অধিকাংশ রাষ্ট্র যদি শান্তি ও নিরাপত্তার প্রশ্নে একমত হতে পারে, তা হলে একটি বা দুটি রাষ্ট্রের পক্ষে অন্যায়ভাবে অন্যের নিরাপত্তা নষ্ট করা সম্ভব হবে না। অধ্যাপক শুম্যান (Schuman) -এর ভাষায় ঃ ‘যৌথ-নিরাপত্তার অর্থ হল শান্তিকামী রাষ্ট্রবর্গ নিজেদের মধ্যে সহযােগিতামূলক শক্তি-সঞ্চয় করে শান্তিভঙ্গকারী রাষ্ট্রগুলিকে শান্তিরক্ষায় বাধ্য করবে। ক্ষুদ্র বা বৃহৎ রাষ্ট্র এককভাবে নিজ নিরাপত্তাবিধানে সুনিশ্চিত থাকতে পারে না। কিন্তু শান্তিকামী রাষ্ট্রগুলি যদি নিজ সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতারক্ষার প্রধান অস্ত্র হিসাবে অপর রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতাকে মর্যাদা দানের মন নিয়ে একত্রিত হতে পারে, তাহলে তাদের স্ব-স্ব নিরাপত্তা বহুগুণ বেশী সুনিশ্চিত হতে পারে। এক্ষেত্রে একটি ক্ষুদ্র বা মাঝারি শক্তিসম্পন্ন রাষ্ট্রকে একটি বৃহৎ রাষ্ট্র বা একটি বৃহৎ রাষ্ট্রকে আর একটি অতি বৃহৎ রাষ্ট্র সহসা আক্রমণ করতে সাহস করবে না।

লীগ-চুক্তিপত্রে যৌথ-নিরাপত্তা ব্যবস্থা

যৌথ-নিরাপত্তার আদর্শের সাথে লীগ-অ-নেশন্স-এর পরিকল্পনা ছিল সম্পূর্ণরূপে সামঞ্জস্যপূর্ণ। লীগ চুক্তিপত্রের দশম ও ষােড়শ অনুচ্ছেদে যৌথ-নিরাপত্তার আদর্শ বিশ্লেষিত হয়েছে। দশম অনুচ্ছেদে লীগের সদস্যদের পরস্পরের রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতাকে সম্মান করতে এবং বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে পরস্পরকে রক্ষা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়। যােড়শ ধারায় বলা হয়েছে যে, যদি লীগের কোন সদস্য-রাষ্ট্র লীগ-চুক্তিপত্রের দ্বাদশ বা পণ্ডদশ অধ্যায়ের অঙ্গীকারকে অস্বীকার করে আগ্রাসী ক্রিয়াকলাপে লিপ্ত হয়, তা হলে লীগের বাকি সদস্যগণ তাদের নিজেদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষিত হয়েছে বলে বিবেচনা করবে।

যৌথ-নিরাপত্তা সম্পর্কে বিভিন্ন রাষ্ট্রের মনােভাব

লীগ-চুক্তিপত্রের উপরে বর্ণিত ধারা দুটিতেই স্পষ্টভাবেই স্বীকার করা হয়েছ যে, শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষা করা কিংবা শান্তি ও নিরাপত্তাভঙ্গকারী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাগ্রহণের জন্য লীগের সদস্যবর্গ যৌথভাবে ব্যবস্থা অবলম্বন করবে। কিন্তু যৌথ-নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে কার্যকর রূপ দেওয়ার ক্ষেত্রে লীগ ক্রমশই পিছিয়ে পড়তে থাকে। কারণ জন্মলগ্ন থেকেই শান্তিরক্ষার মাধ্যম হিসাবে লীগের কার্যকারিতা সম্বন্ধে বহু রাষ্ট্রই সন্দিহান ছিল। প্রথমেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র লীগে যােগ দিতে অস্বীকার করলে তাদের এই ধারণা বদ্ধমূল হয়। পরন্তু কিছু কিছু রাষ্ট্র আশঙ্কা করল যে, এই ব্যবস্থায় তাদের অনর্থক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে হতে পারে। আবার কোন কোন রাষ্ট্র ভাবতে থাকল যে, তাদের নিরাপত্তার অস্ত্র হিসাবে সদস্য-পদই যথেষ্ট নয়। প্রথমােক্ত রাষ্ট্রগুলি বিভিন্নভাবে চাপ সৃষ্টি করে যৌথ-দায়দায়িত্ব সংক্রান্ত ধারাগুলিকে সংশােধন করতে চাইল এবং শেয়ােক্ত রাষ্ট্রগুলি নিজ নিজ নিরাপত্তাকে সুনিশ্চিত করার জন্য লীগের সদস্যপদ গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে আরও নানাপ্রকার আঞ্চলিক বা কর্মসূচীভিত্তিক রাষ্ট্রজোট গঠনের উদ্যোগ নিল। এই দুই প্রচেষ্টায় লীগের যৌথ-নিরাপত্তা সংক্রান্ত আদর্শকে দুর্বল করে তুলল।

১৬ নং ধারার সংশােধন

লীগের দ্বিতীয় অধিবেশনে (১৯২১ খ্রীঃ) চুক্তিপত্রের যােল নম্বর ধারার নতুন ব্যাখ্যা স্বীকৃত হয়। নতুন ব্যাখ্যায় বলা হল,

(১) কোন রাষ্ট্র চুক্তিপত্রের শর্ত ভঙ্গ করেছে কিনা তা প্রত্যেক রাষ্ট্র স্বাধীনভাবে বিবেচনা করতে পারবে।

(২) চুক্তিপত্রের শর্তভঙ্গ হয়েছে বলে লীগ-পরিষদ (council) মনে করলেও, তা সদস্য-রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাগ্রহণে (কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক বা সামরিক) প্রত্যেক রাষ্ট্রের স্বাধীনতা থাকবে।

(৪) কোন সদস্য-রাষ্ট্র যুদ্ধ ঘােষণা করলে তা লীগের সকল সদস্য-রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বলে বিবেচনা করা হবে না।

(৫) আক্রমণকারী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আকস্মিক কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন না-করে তা ধাপে ধাপে করতে হবে। এই পরিবর্তনগুলি সুনিশ্চিত ভাবে লীগের যৌথ-নিরাপত্তার আদর্শকে দুর্বল করে দেয়।

তবে লীগ যৌথ-নিরাপত্তার আদর্শ থেকে সম্পূর্ণভাবে বিচ্যুত হয়েছিল—সে কথা বলা যায় না। অতঃপর সামগ্রিকভাবে নিজের কর্তৃত্ব ধ্বংসের কারণ সৃষ্টি করেও লীগ যৌথ-নিরাপত্তার কাজকে এগিয়ে নিয়ে যায়। অর্থাৎ বিভিন্ন সদস্য-রাষ্ট্রের মধ্যে কর্মসূচীভিত্তিক চুক্তিরচনার জন্য উদ্যোগ নেয়। যৌথ-চুক্তিসমূহঃ বিশ্বযুদ্ধোত্তর ইউরােপের প্রধান সমস্যা ছিল ফ্রান্সের নিরাপত্তার প্রশ্ন। ফ্রান্স মনে করত সুযােগ পেলেই জার্মানী তাকে আক্রমণ করবে এবং ভার্সাই চুক্তির শর্তাবলী ফ্রান্সের নিরাপত্তার পক্ষে যথেষ্ট ছিল না। ফ্রান্সের এই জার্মান-ভীতি দূর করার উদ্দেশ্যে ইংল্যাণ্ড ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ফ্রান্সকে আলাদাভাবে নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিল। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র লীগে যােগদান করতে অস্বীকৃত হলে ফ্রান্সের ভীতি বেড়ে যায়। এমতাবস্থায় ফ্রান্সের দাবিতে এবং লীগের সমর্থনে কয়েকটি পারস্পরিক নিরাপত্তা-চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ১৯২১ খ্রীষ্টাব্দে ফ্রান্স লিটল আঁতাতভুক্ত দেশগুলির (চেকোশ্লোভাকিয়া, যুগােশ্লাভিয়া ও পােল্যান্ড) সঙ্গে এক চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। ফরাসী নিরাপত্তার জন্য যৌথ-ব্যবস্থাকে কার্যকর করার জন্য লীগের চতুর্থ অধিবেশনে (১৯২৩ খ্রীঃ) পারস্পরিক সহায়তা চুক্তির খসড়াপত্র’ (Draft Treaty of Mutual Assistance) গৃহীত হয়। কিন্তু ইংল্যাণ্ডের বিরােধিতার ফলে এটি পরিত্যক্ত হয়। ১৯২৪ খ্রীষ্টাব্দে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ সর্বসম্মতিক্রমে একটি চুক্তির খসড়াপত্র গ্রহণ করে। এটি ‘Protocal for the Specific Settlement of International Dispute’ gialet প্রােটোকল’ নামে খ্যাত। এই চুক্তিপত্রে লীগের সংগঠনগত ও কার্যাবলীর সংশােধন করে লীগকে বাস্তবমুখী ও প্রকৃত অর্থে নিরাপত্তার রক্ষক রূপে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু ইংল্যাণ্ডের আপত্তির জন্য শেষ পর্যন্ত এটিও বাস্তবায়িত করা সম্ভব হয়নি। লীগের নেতৃত্বে যৌথ নিরাপত্তার উল্লেখযােগ্য পদক্ষেপ দেখা যায় ‘লােকার্নো চুক্তি’ স্বাক্ষরের (১৯২৫ খ্রীঃ) মধ্যে। জার্মানী, ফ্রান্স, ইংল্যাণ্ড, বেলজিয়াম, ইতালী, পােল্যাণ্ড ও চেকোশ্লোভাকিয়ার মধ্যে মােট সাতটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। বিজিত ও বিজয়ীর মধ্যে সুসম্পর্ক স্থাপনের এক মহৎ দৃষ্টান্ত ছিল এই চুক্তি। যৌথ নিরাপত্তার শেষ চেষ্টা ছিল ‘কেলগ-ব্রিয়া চুক্তির পরিকল্পনা’। ফরাসী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্রিয়া এবং মার্কিন রাষ্ট্রসচিব কেলগ-এর মধ্যে যুদ্ধবর্জনের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯২৮ খ্রীষ্টাব্দে ‘কেল-ব্রিয়া’ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। পরে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানী, ইতালী, পােল্যাণ্ড, চেকোশ্লোবাকিয়া ও বেলজিয়াম এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করে।

অবাস্তব নীতি

যৌথ-নিরাপত্তা ব্যবস্থা শেষ পর্যন্ত কার্যকরী হয়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দাবানল আবার পৃথিবীর শান্তি ও নিরাপত্তাকে গ্রাস করেছিল। আসলে যৌথ-নিরাপত্তার আদর্শ প্রকৃতিগত ভাবেই ত্রুটিপূর্ণ ছিল। লীগ-অ-নেশন্স-এর মত একটি দুর্বল সংস্থার পক্ষে একে বাস্তবায়িত করা সম্ভব ছিল না। লীগের সাফল্যই নির্ভরশীল ছিল সদস্য-রাষ্ট্রবর্গের সদিচ্ছার উপর। কিন্তু অধিকাংশ রাষ্ট্রই ক্ষুদ্র স্বার্থের উর্ধ্বে উঠতে পারেনি। পারস্পরিক রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক দ্বন্দ্বেও লিপ্ত রাষ্ট্রসমূহের পক্ষে যৌথ নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে সফল করে তােলা সম্ভব ছিল না।

Leave a reply