হাে-চি-মিনের নেতৃত্বে ভিয়েতনামবাসীরা দীর্ঘ ৩০ বছর (১৯৪৫-৭৫ খ্রিঃ) ধরে যে যুদ্ধ চালিয়েছিল তা ভিয়েতনাম যুদ্ধ নামে পরিচিত। বিশ্বজুড়ে সােভিয়েত সাম্যবাদের প্রসার রােধের জন্য মার্কিন আগ্রাসনের নগ্ন রূপ ছিল ভিয়েতনাম যুদ্ধ। প্রথমদিকে ফরাসি সাম্রাজ্যবাদ ও পরে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ভিয়েতনামে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে, চিন ও সােভিয়েত সাহায্যপুষ্ট হয়ে ভিয়েতনামবাসী রুখে দাঁড়ায়। শুরু হয় দীর্ঘস্থায়ী ভিয়েতনামি যুদ্ধ।
ভিয়েতনাম যুদ্ধের কারণ
এই যুদ্ধের কারণ বিশ্লেষণে দেখা যায়-
উপনিবেশ-বিরােধী সংগ্রাম
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে পর্যন্ত, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্তর্গত মালয়, শ্যাম (থাইল্যান্ড), ব্রম্মদেশ (মায়ানমার), ইত্যাদি দেশে উপনিবেশ-বিরােধী সংগ্রাম চরমে পৌঁছেছিল। এইসব উপনিবেশ বিরােধী সংগ্রামে প্রভাবিত হয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ইন্দোচিন (টংকিং, আন্নাম, কোচিন-চিন) তথা ভিয়েতনামে হাে-চি-মিন-এর নেতৃত্বে ফরাসি সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছিল।
রুশ-জাপান যুদ্ধের ফলাফল
রুশ-জাপান যুদ্ধের ফলাফল জাপানের অনুকূলে যাওয়ায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াবাসীর মন থেকে শ্বেতাঙ্গাভীতি দূর হয়। তারা বিশ্বাস করতে শুরু করে যে ভিয়েতনামও ফরাসি সাম্রাজ্যবাদের অবসান ঘটাতে পারবে। ফান-চু-লিন এবং ফান-বােই-চাও প্রমুখের নেতৃত্বে ফরাসি-সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ভিয়েতনামে রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ ঘটে। রাজনৈতিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ ভিয়েতনামবাসী প্রথমে ফরাসি ও পরে জাপানি উপনিবেশ বিস্তারে বাঁধা দিলে ভিয়েতনাম যুদ্ধ বাঁধে।
চিনের প্রজাতান্ত্রিক বিপ্লব
সান-ইয়াৎ-সেনের নেতৃত্বে শ্রমিক ও কৃষক শ্রেণির সক্রিয় সহযােগিতায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধমে চিনে গণপ্রজাতন্ত্রী সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯১১ খ্রিস্টাব্দের চিনের এই প্রজাতান্ত্রিক বিপ্লবের ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ভিয়েতনামিরা ফরাসি সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রস্তুতি নেয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হস্তক্ষেপ
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রথমদিকে ভিয়েতনাম সংকটে হস্তক্ষেপ না করে নিরপেক্ষ থাকে। কিন্তু মাও-জে-দঙ-এর নেতৃত্বে চিনে কমিউনিস্ট শাসন প্রতিষ্ঠিত (১৯৪৯ খ্রিঃ) হলে এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া জুড়ে রুশ মদতে সাম্যবাদের প্রসার ঘটতে শুরু করলে আমেরিকা চুপ করে থাকতে পারেনি। জেনেভা সম্মেলনের পর থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পরােক্ষভাবে দক্ষিণ ভিয়েতনামে ন-দিন-দিয়েম (Ngo-Dinh-Diem) সরকারকে অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করতে শুরু করলে ভিয়েতনাম যুদ্ধ চরমে পৌঁছায়।
পটল্ডাম সম্মেলনের সিদ্ধান্ত
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হওয়ার পর জাপান ইন্দোচিনে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে (১৯৪৫ খ্রিঃ)। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হেরে গিয়ে জাপান আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়। পটল্ডাম সম্মেলনে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, জাপান ইন্দোচিন থেকে সরে এলে ইন্দোচিনের ১৭° অক্ষরেখা বরাবর উত্তরে কুয়ােমিনটাং চিন এবং দক্ষিণে ব্রিটেন দায়িত্ব নেবে। কিন্তু ফ্রান্স ইন্দোচিনে তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে ব্রিটেন দক্ষিণ ইন্দোচিন থেকে সরে যায় এবং কুয়ােমিনটাং চিনও উত্তর ইন্দোচিন হাে-চি-মিনের হাতে তুলে দেয়।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .