সূচনা :- ইউরােপে রেনেসাঁস বা নবজাগরণ এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। প্রাচীন ও মধ্যযুগের কুসংস্কার দূর করে এক নতুন ইউরােপ গঠনের প্রয়াস লক্ষ করা যায়। গ্রীক ও ল্যাটিন সাহিত্য, শিল্প ও সভ্যতার বিকাশ ঘটে এই সময়ে। আর এর প্রভাবে মানুষ নবজন্ম লাভ করে। চারিদিকে দেখা দেয় পরিবর্তনের প্রবাহ। ইউরােপের এই পরিবর্তনে, নবজাগরণে যাদের প্রত্যক্ষ প্রভাব ছিল, তাদের একটি শ্রেণিকে বলা হয়— “হিউম্যানিস্ট’ বা ‘মানবতাবাদী। তাদের প্রয়াস তথা আন্দোলনকে বলা হয়- ‘মানবতাবাদী আন্দোলন।
মানবতাবাদী আন্দোলনে হিউম্যানিস্টদের ভূমিকা :- এ কথা সত্য যে, মানবতাবাদী আন্দোলনে হিউম্যানিস্টদের ভূমিকা ছিল বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এছাড়া রেনেসাঁস বা নবজাগরণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা ছিল—হিউম্যানিস্টদের। হিউম্যানিস্ট সকলে হতে পারেন না। মানুষের প্রকৃতি বা জীবন-জীবিকা সম্পর্কে যাদের জ্ঞান আছে—তারাই হতে পারেন—হিউম্যানিস্ট বলা হয়। তারা প্রাচীন পুঁথি সংগ্রহ করেছেন, অনুবাদ করেছেন, শিক্ষার্থীদের জ্ঞান বিতরণ করেছেন। নিজেরা সাধারণ জীবন যাপন করেছেন। মানুষের কল্যাণে জীবন অতিবাহিত করেছেন। এঁদের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছিলেন—পেত্রার্ক ও বােচিও।
মানবতাবাদী আন্দোলনে পেত্রার্ক : মানবতাবাদী আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের মধ্যে সবার আগে স্মরণ করতে হয় পোর্কের নাম। তিনি ১৩০৪ খ্রিস্টাব্দে ইতালিতে জন্মগ্রহণ করেন। তার অন্যতম সৃষ্টি হল সনেট। ১৪ লাইনের এক বিশেষ শ্রেণির কবিতাকে বলা হয় সনেট। রেনেসাঁসের পথ প্রদর্শক হিসেবে পেত্রার্ক আমাদের কাছে স্মরণীয়। তিনিই প্রথম গ্রীক ও ল্যাটিন সাহিত্য ও সংস্কৃতির গুরুত্ব বুঝেছিলেন। তাই বহু কষ্টে তিনি প্রায় ২০০টি গ্রীক ও ল্যাটিন গ্রন্থ পোর্কের রচিত সাহিত্য পাঠ করে সমকালীন ইউরােপের শিক্ষার্থীরা উৎফুল্ল হয়ে উঠেছিল। তাই বহু যুবক আইন, ধর্মনীতি প্রভৃতি মধ্যযুগীয় শিক্ষা ত্যাগ করে পোর্কের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। সুতরাং নবজাগরণের ক্ষেত্রে পেত্রার্কের অবদান অনস্বীকার্য। তিনি ১৩৭৪ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন তার মৃত্যুর পর এই আন্দোলন অনেকটা ম্লান হয়ে যায়।
মানবতাবাদী আন্দোলনে বােকচিত্ত :- মানবতাবাদী আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের মধ্যে ববাচিও নাম বিশেষভাবে স্মরণীয়। পেত্রার্কের শিষ্যদের মধ্যে বােকাচো বা বােক্কাচিও ছিলেন প্রধান। তিনি ১৩১৩ খ্রিস্টাব্দে ইতালিতে জন্মগ্রহণ করেন। পোর্কের মত তিনিও প্রাচীন গ্রীক ও ল্যাটিন সাহিত্যের প্রতিলিপি ছড়িয়ে দিলেন ইউরােপে। পেত্রাকের আদেশে তিনি গ্রীক ভাষা আয়ত্ত করেন। হােমারের মহাকাব্যদুটি ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদ করেন। তাকে ইতালির গদ্যভাষার জনক বলা হয়। তার উৎকৃষ্ট কাব্যফসল- ‘ডেকামেরণ’ নামক গ্রন্থটি। পেত্রার্কের মত তিনিও নবজাগরণ তথা মানবতাবাদী আন্দোলনের অগ্রদূত। ১৩৭৫ খ্রিস্টাব্দে তার মৃত্যু হয়। তার মৃতুতে এই আন্দোলন কিছুটা স্থিমিত হয়ে পড়ে।
মানবতাবাদী আন্দোলন
রিউক্লিন :- জন রিউক্লিন (১৪৫৫-১৫২২) ছিলেন একজন পণ্ডিত ব্যক্তি। তার হিব্রু ব্যাকরণ তখনকার একখানি অতিশয় মূল্যবান্ গ্রন্থ ছিল। রিউক্লিন ক্যাথলিক ধর্মাধিষ্ঠানের দোষ-ত্রুটির সমালােচনা করেন। ফলে, তার বিরুদ্ধে ধর্মযাজকগণ অত্যন্ত হিংসাত্মক হয়ে ওঠেন। রিউক্লিনের শিষ্যগণ প্রধান শিষ্য হুটেনের নেতৃত্বে ধর্মযাজক ও ধর্মজ্ঞানহীন বিদ্যার্থীদের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন। তারা ‘অজ্ঞাত ব্যক্তিদের চিঠি” এই নাম দিয়ে বহু পত্র প্রকাশ করেন এবং সেগুলিকে যাজকসম্প্রদায় ও বিদ্যার্থীদের দোষ-ত্রুটির উপর কঠোর আঘাত করেন। এর ফলে দেশের একদল লােক যাজকশ্রেণির প্রতি বিরুভাবাপন্ন হয়ে উঠে।
ইরাসমাস ঃ ইরাসমাস (১৪৬৭-১৫৩৬) রিউক্লিনের মতই একজন হিউম্যানিস্ট ছিলেন। তিনি ল্যাটিন ও গ্রীক ভাষায় বাইবেলের সমালােচনা প্রকাশ করেন। তিনি তাঁর। ‘প্রেইজ অ ফলি’ বা ত্রুটি-বিচ্যুতির প্রশংসা’ নামক গ্রন্থে সমসাময়িক ধর্মাধিষ্ঠানের সমালােচনা করেন। জার্মানির ধর্মসংস্কার আন্দোলনে তার প্রভাব ছিল বেশি। এইভাবে মধ্যযুগে ধর্মাধিষ্ঠান ও ধমর্যাজকদের যা কিছু স্বার্থপরতা, কলুষতা তা জনসাধারণের চোখে পড়ে। ফলে মানবতাবাদের প্রসার ঘটতে থাকে।
মানবতাবাদী আন্দোলনে অন্যান্য নেতৃবর্গ :- মানবতাবাদী আন্দোলনে আরাে যারা ভূমিকা পালন করেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন ইংল্যান্ডের জন ওয়াইক্লিফ, ইতালির (ফ্লারেন্সের) স্যাতােনারােলা, জার্মানি তথা রােমের মার্টিন লুথার প্রমুখ।
মূল্যায়ন :- ইউরােপে ‘মানবতাবাদী আন্দোলনের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। এই আন্দোলন নব ইউরােপ নির্মাণ করেছিল। আন্দোলনের নেতৃবর্গের কাছে রেনেসাঁসের অর্থ ছিল ভিন্ন। তারা মনে করতেন—শিল্প, সাহিত্য, ভাস্কর্যে শুধু পরিবর্তন এলেই নবজাগরণ ঘটে না। নবজাগরণের জন্য প্রয়ােজন—মানুষের হৃদয় বা মনের পরিবর্তন। এজন্য মানুষের মনের অন্ধকার বা কুসংস্কার দূর করা আবশ্যক। জ্ঞানের আলাে জ্বেলে। দিলেই মানুষের অন্ধকার দূর হবে। তাই এই জ্ঞান বৃদ্ধির জন্য তারা আজীবন আন্দোলন করেছিলেন। মানবতা বৃদ্ধির জন্য তার নিরলস সংগ্রাম করেছিলেন বলেই তাদের বলা হয়—‘মানবতাবাদী’ বা হিউম্যানিস্ট।
তা বলাই বাহুল্য মধ্যযুগের শিক্ষা, ছিল প্রধানত-ধর্ম-আশ্রিত। তাই সে যুগের মানুষ অন্ধ কুসংস্কারে আচ্ছন্ন ছিল। মানবতাবাদীগণ এই অন্ধকার থেকে মানুষকে সভ্যতার আলােয় নিয়ে এসেছিলেন। এই মহান পন্থাই ছিল মানবতাবাদী আন্দোলনের মূল বৈশিষ্ট্য। এই পন্থার অগ্রদূত ছিলেন যথাক্রমে পেত্রার্ক ও বােকাচো।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .