ভারত বিভাগ পরিকল্পনা
ভারত-বিভাগ পরিকল্পনা ব্রিটিশ ভারতের শেষ ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেনের উদ্যোগে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে জুন মাসে রচিত হয়। ইতিপূর্বে ব্রিটিশ সরকার অখন্ড ভারতের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু কংগ্রেস ও মুসলিম সহমতে না আসায় পরিস্থিতি জটিল হয়ে ওঠে এবং ভারতীয় রাজনীতিতে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে ভাইব্রয়ের দায়িত্বভার গ্রহণ করে মাউন্টব্যাটেন ভারতে আসেন। তিনি দেখলেন, যদি মন্ত্রী মিশনের পরিকল্পনা অনুযায়ী কংগ্রেস ও মুসমিল লীগ যৌথভাবে অন্তবর্থী সরকার পরিচালনা করলেও এই দুটি দলের মধ্যে মতবিরােধ চরম সীমায় পৌঁছেছে। এদিকে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে বিশেষত বাঙলা, বিহার ও পাশ্চাবে হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাহাঙ্গামা এক জটিল অবস্থার সৃষ্টি করেছে। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের মার্চে পাঞ্জাবের পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে। পরিস্থিতি বেসামাল হয়ে পড়ছে বিবেচনা করে জাতীয় কংগ্রেস পাঞ্জাব ও বাংলা বিভাগের দাবি জানায়।
ভারতীয় রাজনীতিতে অচলাবস্থা নিরসনের জন্য কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ দুই দলের সাথে দীর্ঘ আলােচনা পর মাউন্টব্যাটেন ভারতে বিভাগের সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন এবং এই ব্যাপারে একটিগ্রহণযােগ্য প্রস্তাব উপস্থাপিত করলেন। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ৩ রা জুন “ভারত বিভাগ পরিকল্পনা” বা “মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা”ঘােষিত হল। এই পরিকল্পনা অনুসারে ঠিক হল যে, ১৫ ই আগস্ট ভারতবর্ষ স্বাধীনতা পাবে, কিন্তু ধর্মের ভিত্তিতে ভারতবর্ষকে দুই অংশে বিভক্ত করে স্বাধীন ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হবে। ৩ রা জুনের সিদ্ধান্ত কংগ্রেস ও মুসলিম লিগ উভয় দলই মেনে নিল। জুন মাসের মাঝামাঝি সময়ে নিখিল ভারত কংগ্রেস মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা গ্রহণ করল। এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য হল এই যে, দাঙ্গাহাঙ্গামায় বিধ্বস্ত ভারতীয় জনগণকে অনিশ্চিত অবস্থার মধ্যে রাখা কংগ্রেস সমীচীন মনে করল না। এদিকে যদিও মুসলমান অধ্যুষিত প্রদেশগুলির সম্পূর্ণ অংশ মুসলিম লিগ দাবি করছিল, কিন্তু বাংলা ও পাঞ্জাবের হিন্দু-অধ্যুষিত প্রদেশগুলির জেলাগুলির দাবি ছাড়তে হল। মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা এইভাবে দুইটি বিবদমান দলের সমর্থন পেল। পরিকল্পনাটি রচনার ক্ষেত্রে সাংবিধানিক পরামর্শদাতা ভি.পি. মেননের বিশেষ অবদান উল্লেখযােগ্য।
এরপর ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ১৮ই জুলাই ব্রিটিশ পার্লামেন্টে “ভারতীয় স্বাধীনতা আইন” পাশ করা হল। এই আইনের দ্বারা ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়ে ভারত ও পাকিস্তান এই দুইটি স্বাধীন রাষ্ট্রের সৃষ্টি হল। এই আইনের দ্বারা স্থির হল—
(১) ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ আগস্ট ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্র আত্মপ্রকাশ করবে এবং স্বাধীন রাষ্ট্রের মর্যাদা পাবে।
(২) ভারত ডােমিনিয়নের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকবে বােম্বাই, মাদ্রাজ, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, বিহার, পূর্ব-পাঞ্জাব, পশ্চিমবঙ্গ এবং মুসলমান-অধ্যুষিত জেলাগুলি ভিন্ন আসাম, দিল্লি, আজমীর ও কূর্গ। পাকিস্তানের মধ্যে থাকবে ভারতের অবশিষ্ট অণ্ডল, যথা— সিন্ধুপ্রদেশ, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, পশ্চিম-পাঞ্জাব, পূর্ব-বাংলা, বেলুচিস্তান ওঅসমের শ্রীহট্ট।
(৩) উভয় ডােমিনিয়নের গণ-পরিষদ স্বাধীনভাবে নিজ নিজ রাষ্ট্রের শাসনতন্ত্র বা সংবিধানরচনা করবে। যতদিন পর্যন্ত নতুন শাসনতন্ত্র বলবৎ না হচ্ছে, ততদিন দুইটি রাষ্ট্রই ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইন দ্বারা (কিছু রদবদল করে) শাসিত হবে।
(৪) ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ই আগস্ট হতে ভারতের দেশীয় রাজ্যগুলির ওপর ব্রিটিশ সার্বভৌমত্বের অবসান হবে। এই রাজ্যগুলি নিজেদের পছন্দমত ভারত অথবা পাকিস্তান রাষ্ট্রে যােগাদানের অধিকার পাবে।
এইভাবে লর্ড মাউন্টব্যাটেনের ভারত বিভাগ পরিকল্পনা আইনে পরিণত হল। এই আইনের ভিত্তিতে স্যার সিরিল র্যাডক্লিফের নেতৃত্ব ভারত বিভাগ কার্যকর করবার জন্য পাঞ্জাব ও বাংলায় দুইটি সীমানা -কমিশন নিযুক্ত হল। অবশেষে ১৪ই আগস্ট ভারত বিভাগের ভিত্তিতে স্বাধীন পাকিস্তান রাষ্ট্রের উদ্ভব হল এবং পরদিন ১৫ই আগস্ট ভারত স্বাধীন রাষ্ট্রের মর্যাদা পেল।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .