ভারতের উপর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ভারতের রাজনৈতিক তথা অর্থনৈতিক জীবনে গভীর প্রভাব ফেলে। ভারতবাসী যে আশা আকাঙ্খ নিয়ে যুদ্ধে ব্রিটেন তথা মিত্রপক্ষকে সাহায্য করেছিল, যুদ্ধের শেষের দিকে ব্রিটিশ সরকারের মনােভাব ভারতবাসীকে হতাশ করে। কারণ তারা আশা করেছিল ব্রিটিশ সরকার তাদের প্রতিশ্রুতিমত স্বায়ত্তশাসন দেবে।কিন্তু সরকার এই প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করায় ভারতীয়দের মনে অসন্তোষ দেখা দেয়। অন্যদিকে যুদ্ধের ফলে ভারতে এক গভীর অর্থনৈতিক সংকট দেখা দেয়।
১) ভারতীয় মানবসম্পদের অপচয়
ইংল্যান্ডের স্বার্থে প্রায় ১২ লক্ষ ভারতীয় সেনাকে বিভিন্ন রণাঙ্গনে নিয়ােজিত করা হয়েছিল। ফলে ১ লক্ষেরও বেশী ভারতীয় সেনার মৃত্যু হয়েছিল। এর ফলে বেশ কিছু ভারতীয় পরিবার তাদের উপার্জনক্ষম সন্তানকে হারিয়েছিল।
২) খাদ্য সংকট
ভারতীয় সেনা দলের খাবারের প্রয়ােজনে প্রচুর পরিমাণ খাদ্যশষ্য বিদেশে রপ্তানি করা হয়। এমনকি যুদ্ধের জন্য ব্যবহৃত পশু খাদ্য ও ভারত থেকে মেসােপটেমিয়ায় পাঠানাে হয়।
৩) করভার বৃদ্ধি
ব্রিটিশ সরকারের সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থে পরিচালিত এই যুদ্ধের ফলে ভারতীয় অর্থনীতি বিপন্ন হয়ে পড়ে। যুদ্ধখাতে ৩০০ ক্স ব্যয় বৃদ্ধি পায়। জাতীয় ঋণের পরিমানও বৃদ্ধি পায় ৩০ শতাংশ। জনগণের উপর চাপানাে হয় নানা দুর্বহ করের বােঝা। প্রথমেই ছিল বাধ্যতামূলক ‘যুদ্ধকর। আয়করের ওপর অতিরিক্ত গুরুত্ব আরােপ করে বিপুল সংখ্যক মানুষকে আয়করের আওতায় আনা হয়। ১৯১৯-২০ খ্রিঃ মাথাপিছু ১১.৭৫ শতাংশ আয়কর তােলা হয়। এই দুর্বিসহ করভারে সব শ্রেণির মানুষের মনে তীব্র ক্ষোভের সঞ্চার করে।
৪) দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি
এ সময় নিত্যপ্রয়ােজনীয় দ্রব্যাদির মূল্য আকাশছোঁয়া হয়ে পড়ে। যার দূর্বিষহ প্রভাব থেকে কেউই রক্ষা পায়নি। যুদ্ধের সময় ব্রিটেনের কলকারখানাগুলি ব্রিটেনের যুদ্ধ প্রয়ােজন মেটাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এর ফলে ভারতের ব্রিটিশ শিল্পজাত পণ্যের আমদানি প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়া যুদ্ধের প্রয়ােজনে ভারত সরকারও ভারতে উৎপন্ন শিল্প দ্রব্যাদি কিনতে বাধ্য হয়। এর ফলে ভারতে শিল্পজাত দ্রব্যাদির মূল্য প্রবলভাবে বৃদ্ধি পায়। জুডিথ দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধির যে আনুপাতিকসূচি দিয়েছেন তাতে দেখা যায় যে, ১৯১৩ খ্রিঃ ১৪৩, ১৯১৬ খ্রিঃ ১৮৪, ১৯১৮ খ্রিঃ ২২৫, ১৯২১ খ্রিঃ ২৮১, পর্যন্ত মূল্যসূচক বৃদ্ধি পায়। শিল্পদ্রব্যের দাম বৃদ্ধি পেলেও আনুপাতিক ভাবে কৃষিপণ্যের দাম বাড়েনি।
৫) ক্ষতিগ্রস্থ বণিক ও শিল্পপতি
বিশ্বযুদ্ধ ভারতীয় বণিক ও শিল্পপতিদের উপর ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করে। বিশ্বযুদ্ধের ফলে ইংল্যান্ড জাত পণ্যাদির আমদানি প্রচন্ডভাবে হ্রাস পেলে ভারতীয় শিল্পপতিরা আভ্যন্তরিণ বাজার দখলে সুযােগ পায়। যুদ্ধের প্রয়ােজনে ব্রিটিশ সরকার ও ভারতীয় শিল্পপতিদের ওপর নির্ভর করতে বাধ্য হয় এবং তাদের প্রতি সহানুভূতিমূলক নীতি গ্রহণ করেন। এর ফলে ভারতীয় শিল্পপতিরা মুনাফা অর্জন করে। কিন্তু যুদ্ধ শেষ হওয়া মাত্র অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। সরকারেরা ভারতীয় শিল্পপতিদের প্রতি বিমাতৃসুলভ নীতি গ্রহণ করায় ভারতীয় পণ্য ইংরেজ পণ্যের সাথে এঁটে উঠতে পারে না। এছাড়া যুদ্ধ পরবর্তী অর্থনৈতিক দুর্দশার ফলে ভারতের শিল্পদ্রব্যের বিক্রি কমে যায়।
৬) শ্রমিক অসন্তোষ
বিশ্বযুদ্ধ ভারতে শ্রমিক আন্দোলনকেও প্রভাবিত করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কালে ভারতে দেশীয় উদ্যোগে বেশকিছু কলকারখানা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং শিল্পপতিরা প্রচুর মুনাফা অর্জন করেন। এ সত্ত্বেও শ্রমিকদের মজুরি কিন্তু সেভাবে বৃদ্ধি পায়নি। যুদ্ধ শেষে মন্দা ও শ্রমিক ছাঁটাই তাঁদের সর্বনাশের শেষ সীমানায় পৌঁছে দেয়।
সুতরাং বিশ্বযুদ্ধোত্তর ভারতের প্রায় সব শ্রেণীর মানুষের আর্থিক দুরবস্থা চরমে ওঠে। এই অবস্থায় ভারতের জাতীয়তবাদী নেতারা স্পষ্টই বুঝতে পারেন যে, জনগণের সুগঠিত রাজনৈতিক আন্দোলন ছাড়া ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে কোনও সুবিচার পাওয়া সম্ভব নয়। এরূপ পরিস্থিতিতে ভারতে ব্রিটিশ বিরােধী জাতীয় আন্দোলন একের পর এক আছড়ে পড়ে। হােমরুল আন্দোলন ও রাওলাট বিরােধী আইনের মধ্য দিয়ে যা শেষ হয় গান্ধীজীর নেতৃত্বে অসহযােগ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .