খিলাফৎ আন্দোলন
ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে-খিলাফৎ আন্দোলন এক গুরুত্ব পূর্ণ অধ্যায় হিসাবে চিহ্নিত। এই আন্দোলন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে এক নতুন জোয়ার আনে। এই আন্দোলনের মাধ্যমে হিন্দু মুসলিম ঐক্য প্রতিষ্ঠা সহজতর হয় এবং তা শীঘ্রই অসহযােগ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ভারতে এক ব্যাপক গণ আন্দোলন সৃষ্টি করে। ডঃ বিপিন চন্দ্র বলেন যে, “A new stream came into the nationalist movement with the Khilafat movement.
খিলাফৎ আন্দোলনের কারণ
প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের সময় তুরস্ক ইংল্যাণ্ডের বিপক্ষে জার্মানীর সাথে যােগ দিয়েছিল। বিশ্বযুদ্ধের অবসানের পর ইংল্যান্ড ও মিত্রপক্ষ তুর্কী সাম্রাজ্যকে বিচ্ছিন্ন করার সিদ্ধান্ত নেয়। তুরস্কের সুলতানকে ভারতীয় মুসলীমরা খলিফা বা ধর্মগুরু বলে মনে করতেন। ফলে তুর্কী সুলতানের মর্যাদাহানি মুসলীমদের ধর্মীয় চেতনায় আঘাত করে। যুদ্ধ চলাকালেই মুসলীম সমাজ ইংরেজের তুরস্ক নীতিতে ক্ষুব্ধ হয়েছিল। ভারতীয় মুসলীমরাও খলিফার মর্যাদা রক্ষার প্রশ্নে চিন্তান্বিত ছিল। মৌলানা আব্দুল বারি, মৌলানা মহম্মদ আলি, সৌকত আলি প্রমুখের নেতৃত্বে ভারতে খলিফার স্বপক্ষে প্রচার শুরু হয়। ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে বােম্বাই শহরের কিছু মুসলমান বণিকের উদ্যোগে খলিফার সম্মান ও মর্যাদা রক্ষার উদ্দেশ্যে ‘মজলিশ-ই-খিলাফং’ নামে একটি সমিতি স্থাপিত হয়। পরবর্তী পর্যায়ে খিলাফতের সংকট সম্পর্কে ভারতীয় মুসলীমদের কর্তব্য নির্ধারণের জন্য মৌলানা আব্দুল বারির নেতৃত্বে লক্ষ্মেীতে সর্বভারতীয় মুসলীম সমাবেশ আহ্বান করা হয়। বােম্বাইতে এর প্রধান দপ্তর স্থাপিত হয় এবং বিভিন্ন প্রদেশে শাখা কার্যালয় স্থাপিত হয়। সারা ভারতে ১৭ই অক্টোবর খলিফার জন্য প্রার্থনা দিবস’ পালিত হয়। ১৯১৯ খ্রীস্টাব্দের ২৪শে নভেম্বর দিল্লীতে সর্বভারতীয় খিলাফৎ সম্মেলনের প্রথম অধিবেশন আহুত হয়। এই সম্মেলনে গৃহীত এক প্রস্তাবে বলা হয় যে, “সরকার যদি মুসলমানদের দাবিগুলি মেনে না নেয়, তাহলে খিলাফৎ কমিটি সরকারের কোন কাজে সহযােগিতা করবে না।
খিলাফৎ কমিটি
তিলক, গান্ধিজি প্রমুখ খিলাফৎ আন্দোলনের উদ্ভবকে হিন্দু-মুসলীম মৈত্রী প্রতিষ্ঠার সুবর্ণ সুযােগ হিসাবে বিবেচনা করেন। গান্ধিজি স্বীকার করেন যে, আগামী একশাে বছরের মধ্যে এমন সুযােগ হয়তাে আর আসবে না। তিনি খিলাফৎ আন্দোলনে যােগ দিয়ে মুসলমানদের জাতীয় আন্দোলনের মূলস্রোতে যুক্ত করার উদ্যোগ নেন। ইয়ং ইন্ডিয়া’ পত্রিকায় গান্ধিজি লেখেন, “মুসলমানকে যদি আমার ভাই বলে মনে করি, তাহলে তার বিপদ হলে এবং ন্যায় তার দিকে থাকলে, তাকে প্রাণপনে সাহায্য করাই আমরা কর্তব্য।” গান্ধিজির বক্তব্য খিলাফৎদের হৃদয় স্পর্শ করে। মহম্মদ আলি, সৌকত আলি, মৌলানা আবুল কালাম আজাদ, আজমল খাঁ প্রমুখ মুসলীম নেতৃবৃন্দ গান্ধিজির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। নভেম্বর মাসে খিলাফৎ কমিটির বিশেষ অধিবেশনে গান্ধিজিকে সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। এই সম্মেলনে স্থির হয় যে, সরকার খিলাফৎ সমস্যার দ্রুত সমাধান করলে সরকারের প্রতি ‘অসহযােগ নীতি অনুসরণ করা হবে। জুডিথ ব্রাউনের মতে, খিলাফৎ সম্মেলনেই গান্ধিজি সর্বপ্রথম ‘অসহযােগ’ নীতিকে অধিকার আদায়ের অস্ত্র হিসাবে প্রয়ােগের কথা চিন্তা করেন।
খিলাফৎ আন্দোলনের দাবিসমূহ
খিলাফৎ আন্দোলনের মূল দাবি ছিল তিনটি-
১) খলিফার পার্থিব সাম্রাজ্য অটুট রাখা।
২) আরব, সিরিয়া, প্যালেস্টাইন ও মেসােপটেমিয়ার উপর খলিফার কর্তৃত্ব অটুট রাখা।
৩) পবিত্র স্থান মক্কা ও মদিনার উপর বিদেশী হস্তক্ষেপ বন্ধ করা।
১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের শেষ পর্যন্ত খিলাফৎ আন্দোলনের নেতৃত্ব ছিল প্রধানতঃ বােম্বাই নিবাসী বিত্তশালী ব্যবসায়ীদের হাতে। এঁরা সভাসমিতি, স্মারক লিপি ও জনমত গঠনের দ্বারা আন্দোলন চালানাের পক্ষপাতী ছিলেন। ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ১৭ই অক্টোবর ‘খিলাফৎ দিবস পালনের ডাক দেওয়া হয়। হিন্দু ও মুসলমান যৌথ ভাবে খিলাফৎ দিবস পালন করে। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের প্রথম দিকে আলি ভ্রাতৃদ্বয় ও আজাদ জেল থেকে মুক্তি পান এবং খিলাফৎ আন্দোলনে যােগ দেন। এঁদের নেতৃত্বে আন্দোলন নতুন গতিবেগ লাভ করে। ব্রিটিশ সরকার ও মিত্রশক্তি তুরস্ককে ‘সেভরে’-র চুক্তি স্বাক্ষর করতে বাধ্য করলে (মে, ১৯২০ খ্রিঃ) খিলাফৎ আন্দোলন জোরদার হয়। গান্ধিজি এই চুক্তিকে মুসলমানদের ওপর চরম আঘাত’ বলে বর্ণনা করেন।
খিলাফৎ আন্দোলনের কর্মসূচী
১৯৫০ খ্রিঃ জুন মাসে কেন্দ্রীয় খিলাফৎ কমিটি অসহযােগ আন্দোলনের কর্মসূচী গ্রহণ করে। খিলাফৎ আন্দোলনের চার দফা কর্মসূচী ছিল—
১) সরকারি খেতাব ও অবৈতনিক পদ বর্জন,
২) সরকারি ও সামরিক চাকুরি থেকে পদত্যাগ,
৩) সরকারি খাজনা বয়কট,
৪) নির্বাচন বয়কট ও কাউন্সিল থেকে পদত্যাগ।
চতুর্থ শর্তটি সম্পর্কে মতিলাল নেহেরু, চিত্তরঞ্জন দাশ প্রমুখ আপত্তি করেন। কিন্তু গান্ধিজি শর্তটি বহাল রাখেন। কেন্দ্রীয় খিলাফৎ কমিটির পক্ষ থেকে বড়লাটকে জানিয়ে দেওয়া হয় যে, খিলাফতিদের দাবী মানা না হলে ১লা আগস্ট থেকে অসহযােগ আন্দোলন শুরু করা হবে। জাতীয় কংগ্রেসও অসহযােগ আন্দোলন কর্মসূচী ঘােষণা করে। ব্রিটিশ সরকার খিলাপতিদের প্রতি চরমপত্রকে অগ্রাহ্য করে। গান্ধিজি ব্রিটিশ সরকার প্রদত্ত ‘কাইজার-ই-হিন্দ’ পদক প্রত্যাখ্যান করে অসহযােগ খিলাফৎ আন্দোলন শুরু করেন। এভাবে হিন্দু মুসলমানের যৌথ আন্দোলন ভারতীয় রাজনীতিকে উত্তাল করে তােলে।
খিলাফৎ আন্দোলনের অবসান
শেষ পর্যন্ত খিলাফৎ আন্দোলন ব্যর্থ হয়। তুরস্কের জনসাধারণ ১৯৪২ খ্রিঃ ১লা নভেম্বর তুরস্কের সুলতান বা খলিফা চতুর্থ মহম্মদকে পদচ্যুত করে এবং কামাল পাশার নেতৃত্বে তুরস্কে একটি প্রজাতান্ত্রিক সরকার গঠিত হয়। ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে কামাল পাশা ‘খলিফা’ পদটিই তুলে দেন। এর ফলে ভারতে খিলাফৎ আন্দোলন অপ্রয়ােজনীয় হয়ে পড়ে এবং তা বন্ধ হয়ে যায়।
খিলাফৎ আন্দোলনের সীমাবদ্ধতা
খিলাফৎ আন্দোলন সহজাত সীমাবদ্ধতার জন্যই ক্ষণস্থায়ী ছিল এবং আকস্মিক বন্ধ হয়েছিল। এই আন্দোলনের ভিত্তি ছিল ধর্ম। এই আন্দোলনের সঙ্গে ভারতের জাতীয় আন্দোলনের কোন সম্পর্ক ছিল না। খিলাফতিরা উপনিবেশিক শােষণের দিকটা মুসলমান শ্রমিক আর কৃষকদের সামনে তুলে ধরতে পারে নি। এই কারনে মুসলীম মানসে প্রভাব বিস্তার করেছিল ইসলাম ধর্ম, ভারতীয় জাতীয়তাবােধ নয়। তাই জাতীয়তাবােধ শূন্য তাৎক্ষনিক ধর্মীয় আবেগ মুসলমানদের হিন্দুদের কাছাকাছি নিয়ে এলেও তারা পরবর্তী কালে হিন্দুদের কাছ থেকে দুরে সরে গিয়েছিল।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .