অসহযােগ আন্দোলনে জনগণের ভূমিকা
অসহযােগ আন্দোলনের মাধ্যমে ভারতের ইতিহাসে সর্বপ্রথম গণঅভ্যুত্থানের সূচনা হয়েছিল। ১৮৫৭ খ্রিঃ মহাবিদ্রোহের পর ভারতে আর কোন আন্দোলনই এমন গণ অভ্যুত্থানের রূপ নিতে পারেনি। গান্ধিজির আহ্বানে হিন্দু-মুসলীম, নারী-পুরুষ, ধনী-দরিদ্র, শ্রমিক-কৃষক সমগ্র ভারতবাসীর মধ্যে এক অভূতপূর্ব সাড়া জাগে। ড. তারাচাদ বলেন যে, সারা দেশ গভীরভাবে অনুপ্রাণিত হয় এবং লক্ষ লক্ষ দেশবাসীর হৃদয়ে উৎসাহের অভূতপূর্ব বন্যা বয়ে যায়। সর্বত্রই উৎসাহ উদ্দীপনা, দেশপ্রেম ও ত্যাগের অভূতপূর্ব দৃশ্যাবলী পরিলক্ষিত হয়। স্কুল কলেজ, আইন-আদালত, কল-কারখানা ত্যাগ করে হাজার হাজার ছাত্র-শিক্ষক, উকিল-ব্যারিস্টার, শ্রমিক-মজুর, কৃষক ও সাধারণ মানুষ এই আন্দোলনে সামিল হয়। এর সঙ্গে চলতে থাকে বিলেতী পণ্য বর্জন, মাদক বজন, পিকেটিং, বিলেতি পন্যে অগ্নিসংযােগ ও স্বদেশী ব্যবহারের হিড়িক। জওহরলাল নেহেরু, সুভাষ চন্দ্র বসু, রাজেন্দ্র প্রসাদ, পটুভি সীতারামাইয়া, টি. প্রকাশম তাঁদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ বিসর্জন দিয়ে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। মুসলীম নেতৃবৃন্দের মধ্যে মৌলানা মহম্মদ আলি, সৌকত আলি, মৌলানা হজরৎ মােহানী, হাকিম আজমল খাঁন, মৌলানা আবুল কালাম আজাদ আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিক গ্রহণ করেন। মাত্র ছমাসের মধ্যে তিলক স্বরাজ-তহবিল’-এর জন্য সংগৃহীত হয়। এক কোটি পনেরাে লক্ষ টাকা, জাতীয় কংগ্রেসে নতুন সদস্য সংগৃহীত হয় ৫০ লক্ষেরও বেশী এবং দেশবাসীর মধ্যে ২০ লক্ষ চরকা বিতরণ করা হয়।
শিক্ষা বয়কট
শিক্ষার ক্ষেত্রেও অসহযােগ আন্দোলনের যথেষ্ট প্রভাব পড়েছিল। চিত্তরঞ্জন দাশ ঘােষণা করেন, “শিক্ষা অপেক্ষা করতে পারে, স্বরাজের আর অপেক্ষা করার সময় নেই।” নেতাদের আহ্বানে বাংলার শিক্ষক ও ছাত্র সমাজে যথেষ্ট উদ্দীপনা দেখা দিয়েছিল। স্কুল কলেজের ছাত্র সংখ্যা হ্রাস পায়। প্রতি মাসে গড়ে ২০ জন শিক্ষক পদত্যাগ করেন। জাতীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিও এই সময় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এগুলির মধ্যে উল্লেখযােগ্য হল জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া, কাশী বিদ্যাপীঠ, বিহার বিদ্যাপীঠ প্রভৃতি। এইসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে অধ্যাপনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন আচার্য নরেন্দ্র দেব, ড. জাকির হােসেন, ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ, লালা লাজপৎ রায় এবং সুভাষ চন্দ্র বসুর মত কৃতি মানুষেরা।
বস্ত্র বয়কট
অসহযােগ আন্দোলনের বয়কট ছিল একটা হাতিয়ার। বিদেশী বস্ত্র বয়কট আন্দোলন মােটামুটি সাফল্য অর্জন করে। মাত্র ছমাসের মধ্যে কাপড়ের আমদানি ৬.৭ কোটি থেকে ২.৮ কোটি টাকায় নেমে আসে। লােহা ইস্পাত আমদানির ক্ষেত্রেও একই রকম প্রভাব দেখা যায়। এরই পাশাপাশি চলতে থাকে চরকার ব্যবহার এবং স্বদেশী বস্ত্র উৎপাদন। বিপান চন্দ্র বলেন, “Khadi soon became a symbol of freedom”
শ্রমিক আন্দোলন
শ্রমিক শ্রেণিও প্রবল উৎসাহের সঙ্গে এই আন্দোলনে যােগ দেয়। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে প্রায় ৪০০ টি শিল্প-শ্রমিক ধর্মঘট হয়। সরকারি মতে এইসব ধর্মঘটে যােগদানকারী শ্রমিকের সংখ্যা ছিল ৫ লক্ষেরও বেশী। আসামের চা বাগানের প্রায় ১২ হাজার শ্রমিক সামিল হয়। মার্টিন, বার্ণ, জেসপ প্রভৃতি ইউরােপীয় কারখানাগুলিতে ধর্মঘট শুরু হয়। স্বামী বিশ্বানন্দ ও স্বামী দর্শনানন্দের নেতৃত্বে রাণীগঞ্জ ও ঝরিয়ার কয়লাখনিগুলিতে শ্রমিক আন্দোলন শুরু হয়। যতীন্দ্র মােহন সেনগুপ্তের আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে এবং পূর্ববঙ্গের সর্বত্র স্টিমার ধর্মঘট শুরু হয়।
কৃষক আন্দোলন
ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে কৃষকরাও আন্দোলন শুরু করে। উল্লেখযােগ্য কৃষক আন্দোলন হয়েছিলউত্তরপ্রদেশ, প্রতাপগড়, রায়বেরিলিও ফৈজাবাদে। মাদ্রাজ, অন্ধ্রপ্রদেশের গুন্টুর জেলা এবং মালাবারে মােপালা কৃষকরাও ব্যাপক আন্দোলনে যােগ দিয়েছিল। বাংলাদেশের তমলুক ও কাঁথিতে ইউনিয়ন বাের্ডেরকরের বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়। নেতৃত্ব দেন বীরেন্দ্রনাথ শাসমল। পূর্ববঙ্গে নােয়াখালি ও ত্রিপুরায় চাষীরা খাজনা বন্ধ করেছিল। ড. অমলেশ ত্রিপাঠি বলেন যে, “গ্রামাঞ্চলগুলি নতুন উৎসাহের প্রাবল্যে প্রাণচাঞ্চল্য নিয়ে জেগে উঠল।”
নারীদের ভূমিকা
নারী সমাজ দলে দলে পর্দা ছেড়ে বেড়িয়ে এসে সভা, শােভাযাত্রা ও পিকেটিং এ যােগদান করেন। তাঁরা সানন্দে কারাবরণ করতে থাকেন। তিলক স্বরাজ তহবিল’ তাঁদের দানের অলংকারে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। বাসন্তীদেবী, সরলা দেবী, সরােজিনী নাইডু, উর্মিলা দেবী, হেমপ্রভা মজুমদার, জ্যোতির্ময়ী গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখ বঙ্গনারীরা এই আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেন। এইভাবে অসহযােগ আন্দোলন প্রকৃত গণ আন্দোলনে পরিণত হয়।
সরকারী দমন নীতি
আন্দোলনের ব্যাপকতায় ভীত হয়ে নবনিযুক্ত ভাইসরয় লর্ড রিডিং নিষ্ঠুর দমন নীতি গ্রহণ করে। কংগ্রেস ও খিলাফৎ সংগঠনকে বে-আইনী বলে ঘােষণা করা হয়। সভা, সমিতি, মিছিল, সংবাদপত্র ও বাক্ স্বাধীনতার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরােপিত হয়। বহু স্থানে লাঠি ও গুলি চলে। জেলগুলি বন্দীদের ভিড়ে পূর্ণ হয়ে ওঠে। জেল সম্পর্কে মানুষের ভীতি দূর হয়ে যায় এবং কারাগার ‘পবিত্র তীর্থস্থানে পরিণত হয়। গান্ধিজি ছাড়া প্রায় সকল নেতাই কারারুদ্ধ হন।
আন্দোলন প্রত্যাহার
অসহযােগ আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে ৫ই ফেব্রুয়ারী চৌরিচৌরা গ্রামের জনতা ২২জন পুলিশকে অগ্নিদগ্ধ করে মারে। এই ঘটনায় অত্যন্ত ব্যথিত হয়ে শান্তির পূজারী গান্ধিজি এই আলেন ত্যাহার করে নেন। গান্ধিজির এই সিদ্ধান্ত অন্যান্য অধিকাংশ নেতাকেই মর্মাহত করে। কারারুদ্ধ অবস্থাতেই তাঁরা প্রতিক্রিয়া জানান। সুভাষচন্দ্র বসু এই সিদ্ধান্তকে জাতীয় বিপর্যয় বলে অভিহিত করেন। লালা লাজপৎ রায় বলেন যে, “we were simply routed.” মতিলাল নেহেরু বলেন যে, “একটি স্থানের একটি জনতার পাপের জন্য গান্ধিজি গােটা দেশবাসীকে শাস্তি দিলেন,” মার্কসবাদী ঐতিহাসিক রজনীপাম দত্ত মনে করেন যে, বিত্তশালীদের স্বার্থ বিনষ্ট হতে দেখে গান্ধিজি আন্দোলন।
প্রত্যাহার করে নেন।
অসহযােগ আন্দোলন কতটা সফল হয়েছিল
আপাতদৃষ্টিতে অসহযােগ আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছিল। তুরস্কের খলিফার পতন ঘটেছিল, ফলে খিলাফৎ-এর প্রশ্ন অবান্তর হয়ে দাঁড়ায়। আন্দোলনের প্রস্তাব গ্রহণের সময় গান্ধিজি বলেছিলেন, এক বছরের মধ্যে তিনি স্বরাজ এনে দেবেন। স্বরাজ লাভ সম্ভব হয় নি। খিলাফৎ-এর সঙ্গে অসহযােগ আন্দোলনের সংযুক্তির পরিণাম হয়েছিল সাম্প্রদায়িকতার বৃদ্ধি। আর এই আন্দোলন ছিল ব্যক্তি কেন্দ্রিক। গান্ধিজি ছিলেন এই আন্দোলনের অবিসংবাদী নেতা এবং সেটাই ছিল আন্দোলনের প্রধান ত্রুটি। বি.এন. পান্ডে বলেন যে, সামগ্রিকভাবে মধ্যবিত্ত শ্রেণির পূর্ণ সমর্থন না পাওয়ার ফলে এই আন্দোলন ব্যর্থ হয়।
আপাতদৃষ্টিতে অসহযােগ আন্দোলন ব্যর্থ হলেও ভারতের জাতীয় আন্দোলনের ইতিহাসে এর গুরুত্ব ছিল অসীম।
অসহযােগ আন্দোলনে গুরুত্ব
প্রথমত, এই আন্দোলন ভারতে গণ জাগরন ভিত্তিক গণ আন্দোলনের সূচনা করেন। দেশের স্বার্থে সাধারণ মানুষের স্বেচ্ছায় অংশগ্রহণ ও শাস্তি বরণের দৃষ্টান্ত ভবিষ্যত জাতীয় আন্দোলনকে নতুন শক্তি দেয়।
দ্বিতীয়ত, এই আন্দোলন সংগঠনগতভাবে জাতীয় কংগ্রেস এবং ব্যক্তিগতভাবে গান্ধিজির সর্বভারতীয় ভাবমূর্তি তুলে ধরে। কংগ্রেস প্রকৃতই জাতীয় সংগঠনে পরিণত হয়। গান্ধিজি আলিক আন্দোলনের স্তর অতিক্রম করে সর্বভারতীয় রাজনীতি ও আন্দোলনের অঙ্গনে প্রবেশ করেন।
তৃতীয়ত, অসহযােগ আন্দোলন দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রয়াসে সহায়তা করে। অস্পৃশ্যতা মদ্যপান ইত্যাদি সামাজিক ব্যাধির বিরুদ্ধে আন্দোলনের সিদ্ধান্ত দেশ গঠনের কাজ ত্বরান্বিত করে।
চতুর্থত, গান্ধিজি এক নতুন ও অভিনব পদ্ধতির মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদী শাসনের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রাম শুরু করেন। কোন গােপন হিংসাত্বক আন্দোলন নয়-শান্তিপূর্ণভাবে প্রকাশ্য ও প্রত্যক্ষ গণ আন্দোলন শুরু হয়। ড. তারাচাঁদ এই আন্দোলনকে সমগ্র বিশ্বের ইতিহাসে ‘the first unarmed revolt বলে অভিহিত করেছেন।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .