ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধে গান্ধীর ভূমিকা
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সর্বাপেক্ষা উজ্জ্বল নক্ষত্র হলেন মােহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। কবিগুরুর কাছে তিনি মহাত্মা আর জওহরলালের কাছে ‘আলাের ঝলক। সুভাষের বর্ণনায় তিনি জাতির জনক’ | সত্যাগ্রহ ও অহিংসা নামক দুই শাণিত অস্ত্র নিয়ে তিনি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন।
রাজনৈতিক জীবনের সূচনা
১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দের ২রা অক্টোবর গান্ধিজী জন্মগ্রহণ করেন। ব্যারিস্টারি পাশ করে দক্ষিণ আফ্রিকায় গমন করেন প্রবাসী এক মুসলমান ব্যবসায়ীর হয়ে আইনী লড়াইয়ের জন্য। সেখানে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গ সরকারের বর্ণবৈষম্য নীতির বিরুদ্ধে সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু করেন এবং শেষপর্যন্ত জয়যুক্ত হন।
সত্যাগ্রহ
দক্ষিণ আফ্রিকায় তিনি যে শান্তিপূর্ণ প্রতিরােধ আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন তা সত্যাগ্রহ আন্দোলন নামে পরিচিত। টলস্টয় ‘Kingdom of God’ এবং রাকিনের Unto the last গ্রন্থদুটি গান্ধীজীকে এই পথের সন্ধান দিয়েছিল।
স্বদেশ প্রত্যাবর্তন
১৯১৫ খ্রিঃ তিনি ভারতে ফিরে এসে তাঁর রাজনৈতিক গুরু গােপালকৃষ্ণ গােখলের সাথে দেখা করেন এবং তাঁর পরামর্শে কিছু আঞ্জলিক আন্দোলন পরিচালনা করেন। ১৯১৭-১৯১৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে তিনটি আন্দোলন পরিচালনা করেন। ১৯১৭ খ্রিঃ বিহারের চম্পারণে নীল চাষীদের হয়ে আন্দোলন, ১৯১৮ খ্রিঃ আমেদাবাদের। মিল শ্রমিকদের হয়ে আন্দোলন এবং ঐ একই বছরে গুজরাটের খেদায় কৃষকদের হয়ে সত্যাগ্রহ আন্দোলন করেন। এই আন্দোলনগুলির সফলতাতাঁকে ভারতের জাতীয় আন্দোলনে পরিচিতি দেয়।
রাওলাট সত্যাগ্রহ
এরপর গান্ধীজী ইংরেজদের কুখ্যাত রাওলাট আন্দোলনের বিরুদ্ধে সত্যাগ্রহ আন্দোলন গড়ে তোলেন। এই আন্দোলনকে দমন করার জন্য জালিয়ানওয়ালাবাগের প্রাচীর ঘেরা মাঠে, জনসমাবেশের ওপর মাইকেল ও’ডায়ারের নির্দেশে ইংরেজ সেনাবাহিনী নির্বিচারে গুলি বর্ষর্ণ করে। ফলে অসংখ্য নরনারী প্রাণ হাবান। গান্ধীজী এই পাশবিক হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করে বলেন, “This stanic Government cannot be nended, it must be ended.”
খিলাফৎ ও অসহযােগ আন্দোলন
১৯২০ খ্রিস্টাব্দের সেভরের চুক্তি অনুসারে মিত্র শক্তি তুরস্কের খলিফাকে ক্ষমতাচ্যুত করে। এরই প্রতিবাদে সারা পৃথিবীর মুসলমান সমাজ ইংরেজবিরােধী আন্দোলনে মেতে ওঠেন। মহম্মদ আলি, সওকত আলি, মৌলানা আজাদ প্রমুখ মুসলিম নেতাদের সহযােগিতায় গান্ধিজী ব্রিটিশ বিরােধী খিলাফত কমিটি গঠন করেন। এইসময় গান্ধিজী ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে অহিংস অসহযােগ আন্দোলনের ডাক দেন। সারা ভারতের মুসলিম সম্প্রদায় নিজ স্বার্থরক্ষার তাগিদে অসহযােগ আন্দোলনকে সমর্থন করতে থাকেন। হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের যৌথ উদ্যোগে অসহযােগ ও খিলাফত আন্দোলন সর্বাত্মক রূপ ধারণ করে। কিন্তু এই আন্দোলন তিনি চৌরিচৌরার হিংসাত্মক ঘটনার ফলে প্রত্যাহার করেন। এই আন্দোলন ব্যর্থ হলেও অমলেশ ত্রিপাঠী লিখেছেন, “গণ আন্দোলন অনেকটা ভূমিকম্পের, অগ্ন্যুৎপাত বা জলােচ্ছাসের তুল্য।
আইন অমান্য আন্দোলন
অসহযােগ আন্দোলন ব্যর্থ হলেও এই আন্দোলনের পরবর্তী। রাজনৈতিক ঘটনাবলী দ্বিতীয় গণ আন্দোলনের প্রয়ােজনীয়তাকে অবশ্যম্ভাবী করে তুলেছিল। শেষ পর্যন্ত সুভাষচন্দ্র বসু আর জওহরলাল নেহেরুর চাপে গান্ধিজী ১৯২৯খিঃ লাহাের কংগ্রেসে পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি ঘােষণা করতে সম্মত হলেন। এই দাবি আদায়ের জন্য ১৯৩০ খ্রিঃ তাঁর নেতৃত্বে শুরু হল আইন অমান্য আন্দোলন। তিনি লবণ আইন ভঙ্গ করে আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করেন, লবণ আন্দোলন দিকে দিকে সাড়া জাগাল। এই আন্দোলনও শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়। কিন্তু এরই মাধ্যমে ভারতীয়দের সমস্যা আন্তজাতিক সমস্যায় পরিণত হয়। এই আন্দোলনই রচনা করে বৃহত্তর বিপ্লবের পথ।
ভারত ছাড়াে আন্দোলন
ক্রিপস মিশনের ব্যর্থতা ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে গান্ধিজীর নেতৃত্বে কংগ্রেস ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ৮ই আগস্ট ভারত ছাড়াে প্রস্তাব গ্রহণ করে। পরদিনই সমস্ত কংগ্রেস নেতাকে গ্রেপ্তার করা হলে জনগণ নেতৃত্বহীন অবস্থায়। স্বতস্ফূর্তভাবে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। গান্ধিজীর ‘করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গে’-র আহ্বানে ব্রিটিশ শাসনের ভিত কেঁপে ওঠে। শেষ পর্যন্ত এই আন্দোলন ব্যর্থ হলেও ভারতের স্বাধীনতার পথ সুগম হয়।
স্বাধীনতা আন্দোলনের শেষ পর্ব
১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি জেল থেকে মুক্তি পেয়ে গান্ধিজী দেখেন দেশ ক্ৰমশঃ বিভাজনের পথে এগােচ্ছে। তিনি মহম্মদ আলি জিন্নার সাথে বারবার আলােচনায় বসেন কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তিনি না চাইলেও দেশভাগ অনিবার্য হয়ে পড়ে। কংগ্রেস দেশভাগ মেনে নিলেও গান্ধিজী বলেন পরবর্তী প্রজন্ম যেন আমাকে ভুল না বােঝে। তাঁরা অন্ততঃ জানুক এই বৃদ্ধ দেশভাগ চায়নি।
মূল্যায়ণ
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে গান্ধীজী ব্যর্থ নায়ক। তাঁর কোন আন্দোলন। সফল হয়নি। আসলে নিশ্চিত সাফল্য পাওয়ার প্রত্যাশা নিয়ে তিনি আন্দোলনে নামতেন না। তাঁর কাজ ছিল ঢেউয়ের পর ঢেউ জাগানাে। আর প্রতিটি ঢেউয়ের ধাক্কায় সর্বত্র। স্বাধীনতার বার্তা সঞ্চারিত হয়েছিল। তাঁর সীমাবদ্ধতা ছিল এই যে, যে সত্যাগ্রহ তাঁর সাধনার ফল তা সাধারণ মানুষের পক্ষে যে আত্মীকরণ করা সম্ভব নয়, তা তিনি বুঝতে পারেননি। তিনি শুধু রাজনৈতিক মুক্তি নয়, তিনি চাইতেন মানবাত্মার মুক্তি। তাই তাে তিনি জাতির নেতা, জাতির জনক।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .