উনিশ শতকের শেষার্ধে জাতীয়তাবাদের বিকাশের ফলে ভারতবাসীর চিন্তা ও চেতনায় যে জাগরণ শুরু হয় তারই চূড়ান্ত পরিণতি ভারতের জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা (ডিসেম্বর, ১৮৮৫ খ্রিঃ)। প্রতিষ্ঠালাভের পরবর্তীকুড়িবছর (১৮৮৫-১৯০৫খ্রিঃ) জাতীয় কংগ্রেসের আদিপর্ব’ নামে পরিচিত। এইসময় কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ মূলত উদারনৈতিকও নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে দাবি দাওয়া আদায়ে সচেষ্ট ছিলেন। এঁরা সরকারের বিরুদ্ধে কোনরূপ গণ আন্দোলন সংগঠিতকরার পরিবর্তে আবেদন-নিবেদন’এর মাধ্যমে সরকারের সহানুভূতি অর্জনে আস্থাশীল ছিলেন। এই কারণে প্রথম পর্বের নেতাদের নরমপন্থী’ নামে অভিহিত করা হয়। কংগ্রেসের আদিপর্বের নরমপন্থী নেতাদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য ছিলেন দাদাভাই নৌরাজী, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বদরুদ্দিন তৈয়াবজী, গােপালকৃয় গােখলে ফিরােজ শাহ মেহতা প্রমুখ।
দাবিসমূহ
প্রথম পর্বের নেতৃবৃন্দ নরমপন্থী হলেও নিষ্ক্রিয় ছিলেন না। সাংবিধানিক পথে ও নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে ভারতবাসীর দাবি আদায়ের জন্য তাঁরা নিরন্তর প্রয়াস চালান। ইসব দাবিগুলির মধ্যে ছিল সাংবিধানিক, অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক সংস্কারের দাবি।
সাংবিধানিক সংস্কারের দাবি
জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দ বিভিন্ন অধিবেশনে বেশ। কিছু সাংবিধানিক সংস্কার গ্রহণ করে —
(ক) উপযুক্তসংখ্যক ভারতীয় সদস্য নিয়ে রাজকীয় কমিশন গঠন, (খ) ইণ্ডিয়ান কাউন্সিল নামক উপদেষ্টা পরিষদের বিলােপ সাধন, (গ) ব্রিটিশ কমন্সসভায় ভারতের প্রতিটি প্রদেশ থেকে কমপক্ষে দু’জন করে প্রতিনিধি পাঠানাের সুযােগ দান; (ঘ) ভারত সচিবের মন্ত্রণা পরিষদে তিনজন ভারতীয়ের অন্তর্ভূক্ত।
অর্থনৈতিক সংস্কারের দাবি
জাতীয় কংগ্রেস কিছু অর্থনৈতিক সংস্কার দাবি করে— (ক) দেশীয় শিল্পের বিকাশসাধনের জন্য রক্ষামূলক শুল্ক আরােপ, সূতি বস্ত্রের উপর থেকে বৈষম্যমূলক শুল্ক অপসারণ ও ক্ষুদ্র শিল্পের সংরক্ষণ দাবি করে। (খ) কৃষির উন্নতি ও কৃষকের উপর আর্থিক চাপ কমানাের জন্য জাতীয় কংগ্রেস জমির কর হ্রাস, জমির স্বত্ব আইনের পরিবর্তনের দাবি জানায়। (গ) সেচ ব্যবস্থার সম্প্রসারণ ও বন সংরক্ষণ আইন সরলীকরণের দাবি করে। (ঘ) আয়কর, লবণ কর, আবগারি শুল্কের হ্রাস ঘটানাের দাবি জানায়।
প্রশাসনিক সংস্কারের দাবি
শাসনতান্ত্রিক ক্ষেত্রে কংগ্রেনের দাবিগুলি ছিল – (ক) একই সঙ্গে ভারত ও ইংল্যান্ডে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা গ্রহণ। (খ) সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার বয়স ১৯-২১ বছর করা।(গ) স্ট্যাটুটারি সিভিল সার্ভিসের অবসান।(ঘ) কমিশন ব্যাঙ্কে ভারতীয়দের প্রবেশের সুযােগ দান। (ঙ) শাসন বিভাগ থেকে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ, (চ) জুরি ব্যবস্থার প্রবর্তন, পুলিশ প্রশাসনের সংস্কার প্রভৃতি দাবি জানায়।
সীমাবদ্ধতা
১৮৮৫-১৯০৫ খ্রিঃ পর্যন্ত জাতীয় কংগ্রেসের কর্মপদ্ধতি নিয়মতান্ত্রিক আবেদন-নিবেদন নীতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। তাদের অনুসৃত নীতিকে বলা হয়- “A Policy of 3 P’S” ? Reall alle 26- Pray, Please and Protesti কংগ্রেস প্রতিনিধি মন্ডলী প্রতি ডিসেম্বর মাসের ৩টি দিনের জন্য (২৮, ২৯, ৩০) একত্রিত হয়ে নানা প্রস্তাব গ্রহণ করতেন। এই কারণে অশ্বিনীকুমার দত্ত এই কংগ্রেস অধিবেশনকে তিন দিনের তামাশা”বলে অভিহিত করেছেন। জুডিথ ব্রাউন কংগ্রেস সম্মেলনের প্রস্তুতিকে বিয়ে বাড়ির আয়ােজনের সঙ্গে তুলনা করেছেন। বঙ্কিম ‘কৃষচরিতে’ব্যঙ্গ করে বলেছেন, “জয় রাধেকৃয়, ভিক্ষা দাও গাে– ইহাই আমাদের পলিটি” চরমপন্থী নেতা লালা লাজপত রায় বলেছেন- “২০ বছর ধরে তারা যে আন্দোলন করেছিলেন, সরকারের। কাছে থেকে সুবিচার ও সুবিধা আদায়ের জন্য তা প্রায় বিফলই হয়েছিল। তারা চেয়েছিলেন রুটি পেয়েছিলেন যেন পাথরের টুকরাে।”
মূল্যায়ণ
সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও একথা বলতে হবে যে, এই যুগের কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ প্রকৃতই দেশকে ভালােবাসতেন। তাদের দেশপ্রেমে কোনাে খাদ ছিল না। এরা ভারতবাসীর মধ্যে ব্রিটিশ অপশাসনের স্বরূপ উদ্ঘাটিত করে জাতীয় চেতনা সঞ্চারিত রতে সক্ষম হয়েছিল। ঐতিহাসিক বিপিন চন্দ্র লিখেছেন— “The period from 1885-1905 was the seed time of Indian nationalism and the arliest nationalism sowed the seeds well and deep.”
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .