আলিগড় আন্দোলন
ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে রাজা রামমােহন রায় যেমন যুক্তিবাদী চিন্তাধারা ও পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রসারের দ্বারা হিন্দু সমাজে নবজাগরণের সূচনা করেছিলেন, তেমনি স্যর সৈয়দ আহমদ খানও উনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগে মুসলমান সমাজে পাশ্চাত্য শিক্ষা ও ভাবধারায় প্রসার ঘটিয়ে ওই সম্প্রদায়ের মধ্যে নতুন চেতনার সঞ্চার করেছিলেন। প্রথমদিকে মুসলমানরা পাশ্চাত্য শিক্ষার বিস্তারকে সন্দেহের চোখে দেখতেন এবং তারা ইসলামি শিক্ষাব্যবস্থায় আত্মসন্তুষ্ট ছিলেন। এই নির্লিপ্ততা ও বিরােধিতার অবশ্যম্ভাবী ফল হিসাবে মুসলমানরা হিন্দুদের থেকে শিক্ষাদীক্ষা ও আর্থিক সুযােগসুবিধা লাভে পিছিয়ে পড়েছিলেন। ইংরেজ মুসলমান শাসনের অবসান ঘটিয়েছে—এজন্য তাঁরা ইংরেজদের সব কিছুই বর্জন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এই মানসিকতার অযৌক্তিকতা উপলব্ধি করে পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত সৈয়দ আহমদ খান মুসলমান সমাজকে পাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করতে শুরু করেন।
সৈয়দ আহমদের লক্ষ্য
১৮১৭ খ্রীস্টাব্দে স্যার সৈয়দ আহমদ খাঁন রায়বেরিলির এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের জন্মগ্রহণ করেন। মহাবিদ্রোহের সময় তিনি বিজনুরে সদর আমিন পদে নিযুক্ত ছিলেন। ১৮৬৯-১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে তার ইংল্যান্ডে ভ্রমণ তার চেতনায় গভীর প্রভাব বিস্তার করে। তিনি ইংল্যান্ডের শিক্ষাব্যবস্থা ও আধুনিক বৈজ্ঞানিক চিন্তাভাবনার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ইসলাম ধর্ম ও মুসলমান সমাজের আধুনিকীকরণে চেষ্টা করেন। ঐতিহ্যের ওপর অহেতুক নির্ভরতাকে ত্যাগ করে তিনি মুসলমানদের যুক্তিনির্ভর ও স্বাধীন চিন্তার অধিকারী হতে আহ্বান করেন। আর এরজন্য মুসলমানদের পাশ্চাত্য বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারা এবং সংস্কৃতি চর্চার একান্ত এয়াইন।
সমাজ সংস্কার
রাজা রামমােহনের মতােই স্যার সৈয়দ আহমদ খাঁন সমস্ত রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে জেহাদ ঘােষণা করেন। তিনি মুসলমান সমাজকে অজ্ঞতা, কুসংস্কার এবং গোঁড়ামির হাত থেকে মুক্ত করার জন্য নিরবচ্ছিন্নভাবে সংগ্রাম চালাতে থাকেন। কোরানকেই তিনি একমাত্র প্রামান্য গ্রন্থ বলে মনে করতেন। তিনি আধুনিক চিন্তা ও যুক্তির আলােকে কোরানের ব্যাখ্যা দেন। তিনি মুসলমান সমাজের পীর ও মুরাদি প্রথার কঠোর সমালােচনা করেন। তিনি মুসলমান নারী সমাজের প্রগতির ওপর জোর দেন। তিনি মুসলমান বিবাহ নীতি ও তালাক প্রথার তীব্র নিন্দা করেন।
রক্ষণশীলদের বিরােধীতা
রাজা রামমােহনের মতাে স্যর সৈয়দ আহমদকেও রক্ষণশীলদের প্রচন্ড প্রতিকুলতার সম্মুখীন হতে হয়। রক্ষণশীল মুসলমানরা তাঁর প্রগতিশীল মনােভাবকে মেনে নিতে পারেননি। নারী সমাজের অগ্রগতির জন্য তার প্রচেষ্টাকে তারা সমালােচনা করেছিলেন। মৌলবি এবং উলেমাদের মতে ইংরেজি শিক্ষার প্রতি বিশ্বাস সৃষ্টি করা কঠিন কাজ ছিল। আলিবক্স খাঁ এবং সৈয়দ ইমদাদ আলির মতাে গোড়াপন্থীরা ইংরেজি শিক্ষার বিরােধীতা না করলেও তারা চেয়েছিলেন ধর্মসংস্কার আন্দোলন বন্ধ রাখতে।
শিক্ষা সংস্কার
স্যর সৈয়দ আহমদ মনে করতেন পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত না হলে মুসলমানরা কোনােদিনই হিন্দুদের সমকক্ষ হতে পারবে না। এই উদ্দেশ্যে ১৮৬৪ খ্রীষ্টাব্দে তিনি গাজিপুরে একটি ইংরেজি বিদ্যালয় স্থাপন করেন। বিজ্ঞান সমিতির প্রতিষ্ঠা করে তার মাধ্যমে তিনি ইংরেজি গ্রন্থাবলির উর্দু অনুবাদগুলি বিতরণের ব্যবস্থা করেন। অক্সফোর্ড ও কেমব্রিজের অনুকরণে ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করেন। মহামেডান অ্যাংগ্লো ওরিয়েন্টাল কলেজ। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে এই কলেজ আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়। এই কলেজকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠে আলিগড় আন্দোলন।
রাজনৈতিক চিন্তাধারা
সৈয়দ আহমদ প্রথম জীবনে ধর্মান্ধ ছিলেন না। তিনি হিন্দু-মুসলিম ঐক্যে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি বলতেন হিন্দু-মুসলিম ভারতমাতার দুই চক্ষু। কিন্তু পরবর্তীকালে তার এই মানসিকতার পরিবর্তন ঘটে। তার মধ্যে দেখা দেয় সাম্প্রদায়িকতার মনােভাব। তিনি বলেন হিন্দু-মুসলমান দুটি পৃথক জাতি। তার এই মতাদর্শ মুসলমান সমাজের মধ্যে দ্রুত প্রসার লাভ করতে থাকে। তিনি ভারতীয় জাতীয় আন্দোলন থেকে মুসলিমদের দুরে থাকার এবং ব্রিটিশের সঙ্গে। সহযােগিতা করার পরামর্শ দিতেন। তাই ব্রিটিশের আস্থা অর্জনের জন্য ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি কংগ্রেসের বিপরীত সংগঠন হিসাবে United Patriotic Association প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর তিনি ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে স্থাপন করেন Mohamedan Anglo Oriental Defence Association। এই সংগঠনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল—
১) মুসলমানদের রাজনৈতিক অধিকার রক্ষা করা;
২) ইংরেজ শাসনকে সমর্থন করা এবং
৩) ইংরেজ শাসনের প্রতি অধিকতর মুসলমানদের আনুগত্য সৃষ্টি করা।
আলিগড় আন্দোলনে বেকের ভূমিকা
আলিগড় কলেজের অধ্যক্ষ থিয়ােডর বেক ছিলেন সৈয়দ আহমদের রাজনৈতিক বিষয়ক পরামর্শদাতা। দুই জাতি তত্ত্ব ও বিচ্ছিন্নতাবাদ প্রসারে আলিগড় কলেজের অধ্যক্ষ থিয়ােডর বেক বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করেন। বেকের পরামর্শে সৈয়দ আহমদ চরম হিন্দু বিদ্বেষী এবং জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রধান শত্রুতে পরিণত হন। বেকের পরিচালনাধীন আলিগড় কলেজ সম্প্রদায়িকতার তীর্থস্থান হয়ে দাঁড়ায়। বেক প্রচার করেন যেন আলিগড় কলেজের ছাত্রগণ ব্রিটিশ সাম্রাজ্য রক্ষার জন্য যেকোনাে ত্যাগ স্বীকার করতে কুণ্ঠিত নয়। ভারতের ব্রিটিশ শাসকগণ এদেশের ওপর আধিপত্য স্থায়ী করার জন্য এবং জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে দুর্বল করার উদ্দেশ্যে আলিগড় আন্দোলনের পূর্ণ সুযােগ গ্রহণ করতে থাকে এবং সরকারি ক্ষেত্রে divide and rule policy অবলম্বন করে। তাই অনেকে বলেন যে সৈয়দ আহমদের ওপর বেকের প্রভাব পড়ার ফলেই এই ঘটনা ঘটেছিল। কিন্তু এই মত সম্পূর্ণ সমর্থনযােগ্য নয় কারণ আলিগড় কলেজ প্রতিষ্ঠার পূর্বেই তিনি হিন্দু মুসলিম ঐক্যের বিরােধিতা করেন। তাছাড়া তাঁর মতাে বিচক্ষণ ও শিক্ষিত ব্যক্তি অপরের দ্বারা প্রভাবিত হবেন একথা স্বীকার করা যায় না।
আলিগড় আন্দোলনের ফলাফল
স্যার সৈয়দ আহমদ ও আলিগড় আন্দোলন ভারতে মুসলমান সমাজের অগ্রগতির জন্য এক বিরাট ভূমিকা পালন করলেও জাতীয় আন্দোলনে এর ভূমিকা ছিল বিতর্কিত ও দুঃখজনক। তিনিই প্রথম দ্বিজাতি তত্ত্বের কথা বলেন এবং প্রচার করেন। এর ফল শুভ হয়নি। অনেক ঐতিহাসিক মন্তব্য করেছেন যে ইহা হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে স্থায়ী বিভেদ সৃষ্টি করে। এই বিভেদের চরম পরিণতি হল ভারত উপমহাদেশকে দ্বিখন্ডিত করে ভারত যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তান রাষ্ট্রের উৎপত্তি। আলিগড় আন্দোলন রাজনৈতিক দিক থেকে যে ভূমিকা পালন করুক না কেন এই আন্দোলন অনস্বীকার্য ভাবে মুসলমান সমাজের সর্বাঙ্গীন উন্নতির পথনির্দেশ করেছিল।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .