বাংলার সমাজ সংস্কার আন্দোলন
উনিশ শতকে ভারতে নবজাগরণের ফলে ভারতের ধর্মীয় ও সামাজিক ক্ষেত্রে ব্যাপক সংস্কারমূলক কর্মপ্রয়াস শুরু হয়। এক্ষেত্রে ভারতপথিক রামমােহন রায় কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্মসভা (১৮২৮ খ্রিঃ) ধর্মীয় ও সমাজিক সংস্কার আন্দোলনের ক্ষেত্রে এক উল্লেখযােগ্য ভূমিকা গ্রহণ করে।
রামমােহন ও ব্রাহ্মসমাজ
একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী ও পৌত্তিলিকতা বিরােধী ব্যক্তিদের সম্মেলনের জন্য তিনি ১৮২৮ খ্রিঃ স্থাপন করেন ব্রাম্মসভা। ১৮৩১ খ্রিঃ তিনি উদ্বোধন করেন ব্রাম্মসমাজ ভবনের। যে কোন ধর্মের লােক এই ভবনে এসে একেশ্বরের উপাসনা করতে পারত।
দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর
১৮৩৩ খ্রিঃ রামমােহনের মৃত্যুর পর ব্রাহ্-আন্দোলন কিছুটা স্তিমিত হয়ে পড়ে। এরপর নতুন করে রামমােহনের ভাবধারা ও জীবনাদর্শকে প্রতিষ্ঠিত করেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। দেবেন্দ্রনাথই ব্রাহ্মসমাজকে ব্রাহ্ম ধর্মে রূপান্তরিত করেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত ‘তত্ত্ববােধিনী পত্রিকায় ব্রাত্ম ধর্মের স্বরূপ ব্যাখ্যা করা হতে লাগল। এই ধর্মমত প্রচারের উদ্দেশ্যে কয়েকজন প্রচারক নিযুক্ত হলেন এবং সমবেত প্রার্থনার নিয়ম প্রবর্তিত হল। হিন্দুদের আদি ধর্মগ্রন্থ বেদ ব্রাত্মধর্মের ভিত্তি হল।
কেশবচন্দ্র সেন
১৮৫৭ খ্রিঃ কেশবচন্দ্র সেন ব্রাহ্মসমাজে যােগদান করলে নতুন ধর্মমত বিশেষ বিস্তার লাভ করে। কেশবচন্দ্র ও তার ঘনিষ্ঠ অনুগামীরা যুক্তিবাদের আলােকে ব্রাম্মসমাজে অসবর্ণ বিবাহ, বহুবিবাহ, বাল্যবিবাহ, জাতিভেদ প্রথার বিরুদ্ধে প্রবল আন্দোলন সৃষ্টি করেন। কিছুদিনের মধ্যেই নীতিগত প্রশ্নে দেবেন্দ্রনাথের সাথে কেশবচন্দ্র ও তার অনুগামীদের মধ্যে মতভেদ ঘটে এবংতরুণ ব্রারা কেশবচন্দ্রের নেতৃত্বে ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠা করেন। কেশবচন্দ্রের পরিচালনায় ব্রাহ্বসমাজ শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ছিল না, সমাজ সংস্কারের ক্ষেত্রেও বিশেষ তৎপর হয়েছিল। নারীজাতির উন্নতি, শ্রমিকশ্রেণির শিক্ষাব্যবস্থা, মাদকদ্রব্য বর্জন প্রভৃতি ব্যাপারে ব্রাত্যসমাজ জনমত গঠনে সচেষ্ট হয়। কিন্তু কেশবচন্দ্রের সঙ্গে শিবনাথ শাস্ত্রী, আনন্দমােহন বসু প্রমুখ নবীন ব্রায় নেতাদের বিরােধ সৃষ্টি হলে তারা ১৮৭৮ খ্রিঃ সাধারণ ব্রাত্যসমাজের প্রতিষ্ঠা করেন। কেশবচন্দ্র সেন ১৮৮০ খ্রিঃ নববিধান প্রতিষ্ঠা করেন।
অবদান
বাংলা তথা ভারতের ধর্ম ও সমাজ জীবনে ব্রাহ্মসমাজের আন্দোলন গভীর প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হয়। এর ফলে হিন্দুধর্মের নবজাগরণ ও সংস্কার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। সামাজিক কু-রীতিসমূহ জনপ্রিয়তা হারাতে থাকে। শিক্ষা বিস্তারের ফলে মানুষের মনে যুক্তিবাদ স্থান পেতে থাকে। ব্রাহ্ম সমাজ কর্তৃক ভারতীয় সাংস্কৃতিক ঐক্যের তত্ত্ব প্রচারিত হবার ফলে জাতীয় ঐক্যবােধ জাগরিত হতে থাকে। ফলে জাতীয়তাবাদী চেতনা দেখা দেয়। ডঃ দেশাই বলেন, “ব্রাহ্মসমাজ ছিল জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের পথিকৃৎ।”
শ্রীরামকৃয়
উনবিংশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে হিন্দুধর্ম তথা সমগ্র হিন্দু ধর্ম আন্দোলনকে বিশেষভাবে ত্বরান্বিত করেছিলেন শ্রীরামকৃয় পরমহংসদেব। একেশ্বর বা বহুঈশ্বর প্রভৃতি তর্কে সাধারণ মানুষ যখন দিশেহারা তখন রামকৃয় শােনালেন ‘যত মত তত পথ’-এর বাণী। হিন্দু, মুসলমান, খ্রিষ্টান সব ধর্মমতে ছিল তার আস্থা। তিনি সহজ সরল ভাষায় বােঝালেন ‘জল’ যেমন কারাে কাছে পানি বা ওয়াটার তেমনি ভগবানও কারও কাছে আল্লাহ বা গড। এইভাবে সর্বধর্ম সমন্বয়ের বাণী তিনি মানুষের কাছে প্রচার করেন।
স্বামী বিবেকানন্দ
শ্রীরামকৃষ্ট্রের বাণীকে বিশ্বের দরবারে হাজির করে স্বামী বিবেকানন্দ। শিকাগাে ধর্মমহাসম্মেলনে (১৮৯৩ স্বামীজির বাণী দেশ-বিদেশে যুব সমাজকে উদ্বুদ্ধ করে মানব সেবার মহান ব্রতে। সমাজের দরিদ্র, অবহেলিত নিপীড়িত মানুষের মধ্যেই তিনি ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষ করেন এবং জীব প্রেমকে ঈশ্বর আরাধনার শ্রেষ্ঠ পথ বলে ঘােষণা করেন।শ্রীরামকৃন্ত্রের আদর্শকে বাস্তবে রূপায়িত করার উদ্দেশ্যে বিবেকানন্দ রামকৃষ্ণ মিশন’ প্রতিষ্ঠা করেন। মানবধর্ম ও সংস্কৃতির উজ্জীবনে এই সংস্থার অবদান অবিস্মরণীয়।
পরিশেষে বলা যায় উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে এই সমস্ত ধর্মীয় ও সমাজ সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে ছিল মানবতাবাদ ও যুক্তিবাদ। এইসব আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল জাতীয় অগ্রগতি।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .