ব্রাহ্মসমাজ আন্দোলন
উনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে যে সংস্কার আন্দোলন শুরু হয়েছিল তাতে ব্রাহ্মসমাজের গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল। ধর্মীয় গোঁড়ামি ও সমাজ থেকে কুসংস্কার দূর করার লক্ষ্যে রামমােহন রায় ১৮২৮ খ্রিঃ ব্রায়সভা প্রতিষ্ঠা করেন। রামমােহন মারা যাওয়ার পর মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রাত্মসভার কার্যভার গ্রহণ করেন। ১৮৫৭ খ্রিঃ কেশবচন্দ্র সেন ব্রাহ্মসমাজে যােগ দিলে ব্রাত্ম আন্দোলন গতিশীল হয়ে ওঠে। কেশবচন্দ্র ও তার ঘনিষ্ঠ অনুগামীগণ যুক্তিবাদের আলােকে ব্রাহ্মসমাজে অসবর্ণ বিবাহ, বহুবিবাহ, বাল্যবিবাহ, জাতিভেদ প্রথার বিরুদ্ধে প্রবল আন্দোলন সৃষ্টিকরেন।
ব্রাহ্মসমাজে ভাঙন
কিছুদিনের মধ্যেই নীতিগত প্রশ্নে কেশবচন্দ্র সেন, শিবনাথ শাস্ত্রী প্রমুখ নবীন সদস্যদের সাথে দেবেন্দ্রনাথের মতবিরােধ দেখা দেয়। কেশবচন্দ্রের অনুগামী শিবনাথ শাস্ত্রী, আনন্দমােহন বসু, বিজয়কৃয় গােস্বামী প্রমুখ প্রতিষ্ঠা করেন ভারতীয় ব্রাত্ম সমাজ (১৮৬৬ খ্রিঃ) এবং দেবেন্দ্রনাথ পরিচালিত অংশ আদি ব্রাক্ষ্মসমাজ নামে পরিচিত হয়। রক্ষণশীলতার জন্য আদিব্রাম্মসমাজ দ্রুত জনপ্রিয়তা হারিয়ে ফেলে।
ব্রাহ্মসমাজে আন্দোলন
কেশবচন্দ্র সেন ছিলেন অসাধারণ বাগ্মী ও সুসংগঠক। তার নেতৃত্বে ব্রাহ্মসমাজ জাতিভেদ, পৌত্তলিকতা প্রভৃতির বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়। তাঁর নেতৃত্বে সমাজ পর্দা প্রথার অবসান, স্ত্রী শিক্ষার প্রসার, পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার ও বাল্য বিবাহ বন্ধের কর্মসূচী গ্রহণ করেন। এদের আন্দোলনের ফলে সিভিল ম্যারেজ অ্যাক্ট ও নেটিভ ম্যারেজ অ্যাক্ট প্রবর্তিত হয়। এই দুটি আইন বলে বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ নিষিদ্ধ হয় এবং অসবর্ণ বিবাহ ও বিধবা বিবাহ আইন সিদ্ধ হয়। বর্ণভেদের বিরােধিতা অনেকটাই সফল হয়েছিল। নারী মুক্তি আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানিয়ে কেশবচন্দ্র সেন, বামাবােধিনী’ পত্রিকা ও পরিচারিকা’শীর্ষক পত্রিকা প্রকাশ করেন। শিক্ষার সার্বিক প্রসারে বিশেষত স্ত্রী। শিক্ষার বিস্তারে ব্রাহ্মসমাজ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে গিয়েছে।
১৮৭১ খ্রিঃ কেশবচন্দ্র নেটিভ লেডিসফম্যাল স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়া ১৮৭২ খ্রিঃ প্রতিষ্ঠা করেন অ্যালবার্ট কলেজ।
সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ
ক্রমে ব্রাক্ষ্মসমাজের নবীন সদস্যদের সাথে কেশবচন্দ্রের মতভেদ প্রকট হয়ে ওঠে। কেশবচন্দ্রের অবতারবাদ, নেটিভ ম্যারেজ আইন ভঙ্গ করে নিজের নাবালিকা কন্যার সাথে কোচবিহারের মহারাজার বিবাহ দান প্রভৃতি কাজে নবীন সদস্যরা প্রগতিবিরােধী বলে প্রতিবাদ জানান, এমনকি তারা তার বিরুদ্ধে অর্থ তছরুপের অভিযােগও আনে। অবশেষে শিবনাথ শাস্ত্রীর নেতৃত্বে নবীন গােষ্ঠী সাধারণ ব্রাক্ষ্মসমাজ নামে আলাদা সংস্থা গঠন করে (১৮৭৮ খ্রিঃ)। কেশবচন্দ্রের নেতৃত্বাধীন সমাজ নববিধান’ নামে পরিচিত হয়।
মূল্যায়ণ
বাংলা তথা ভারতের ধর্ম ও সমাজ জীবনে ব্রাহ্মসমাজের আন্দোলন গভীর প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হয়। এর ফলে হিন্দুধর্মের নবজাগরণ ও সংস্কার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। সামাজিক কুরীতিসমূহ জনপ্রিয়তা হারাতে থাকে। শিক্ষা বিস্তারের ফলে মানুষের মনে যুক্তিবাদ স্থান পেতে থাকে। ব্রাহ্মসমাজে কর্তৃক ভারতীয় সাংস্কৃতিক ঐক্যের তত্ত্ব প্রচারিত হবার ফলে জাতীয় ঐক্যবােধ জাগরিত হতে থাকে। ফলে জাতীয়তাবাদী চেতনা দেখা দেয়। ডঃ দেশাই বলেন, “ব্রাহ্মসমাজ ছিল জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের পথিকৃৎ।” কেউ কেউ বলেন যে, ব্রাহ্মসমাজ আন্দোলন ছিল এলিটপন্থী, শিক্ষিত বুদ্ধিজীবীদের একটি শহরকেন্দ্রিক আন্দোলন। সুদূর গ্রামাঞ্চলের সাধারণ মানুষের মনে এর প্রভাব ছিল না।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .