আলাউদ্দিন খলজির রাজতান্ত্রিক আদর্শ
আলাউদ্দিনের রাজতান্ত্রিক আদর্শের মূলকথা ছিল সীমাহীন স্বৈরতন্ত্র। তিনি ছিলেন ব্যক্তিগত মর্যাদা ও রাজার স্বর্গীয় অধিকারতত্ত্বে বিশ্বাসী। তিনি সুলতানি রাজতন্ত্রকে একটি স্বনির্ভর ও লৌকিক নিয়ন্ত্রণমুক্ত প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
স্বর্গীয় অধিকারতত্ত্ব
বলবনের মতাে আলাউদ্দিন খলজিও সুলতানের স্বর্গীয়। অধিকারতত্ত্বে বিশ্বাসী ছিলেন। আলাউদ্দিন নিজেকে সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের প্রতিনিধি বলে মনে করতেন। তাঁর মতে, ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি বিশেষ গুণাবলি, ক্ষমতা ও মর্যাদার অধিকারী। তার ইচ্ছাই হল রাষ্ট্রের আইন। সুলতান অতুলনীয় এবং রাষ্ট্রের সমস্ত মানুষ তার ভৃত্য বা প্রজা।
সর্বাধিনায়ক
আলাউদ্দিন খলজি ছিলেন তার শাসনব্যবস্থার সর্বাধিনায়ক। তিনি চরমস্বৈরতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি রাজাকেই রাষ্ট্রের সমস্ত শক্তির আধার বলে মনে করতেন। তিনি রাজার আত্মীয়তার বন্ধন স্বীকার করতেন না। রাজার সঙ্গে প্রজার সম্পর্ককে তিনি প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্ক বলেই মনে করতেন। তিনি মনে করতেন, যে রাজা স্বয়ং সমস্ত পার্থিব শক্তির নিয়ন্ত্রণের ঊর্ধ্বে।
রাষ্ট্র ও ধর্মের পৃথকীকরণ
আলাউদ্দিন মুসলিম ধর্মাবলম্বী ছিলেন—এ কথা তিনি গর্বের সঙ্গে ঘােষণা করলেও তার রাজতন্ত্রকে ধর্মের ওপর নির্ভরশীল করেননি বা ধর্মকে রাজতন্ত্রের ওপর স্থাপন করেননি। তিনি সদর্পে ঘােষণা করেন যে, রাষ্ট্রনীতি’ ও ‘ধর্মনীতি’ সম্পূর্ণ পৃথক। তাই উলেমাদের কাজকর্ম থেকে রাষ্ট্রীয় কাজকর্মকেতিনিপৃথক করেন। তিনি বেয়ানার কাজি মুঘিসুদ্দিনকে বলেন, “কোটি আইনসম্মত বা আইনসম্মত নয়, তা আমি জানি না। রাষ্ট্রের পক্ষে যা কল্যাণকর বা আপকালে যা জরুরি বলে মনে করি, আমি তা-ই করি। সেক্ষেত্রে বিচারের দিন আমার কী হবে সে কথা আমি চিন্তা করি না।”
উলেমাদের দমন
সুলতানি প্রশাসনে উলেমা শ্রেণির সীমাহীন প্রভাব-প্রতিপত্তি ছিল। শরিয়ত’-এর ব্যাখ্যাকর্তা হিসেবে তারা সুলতানদের শরিয়তের বিধান অনুসারে দেশশাসন করতে বাধ্য করতেন। কিন্তু আলাউদ্দিন উলেমা শ্রেণির এই প্রতিপত্তি মানতে রাজি ছিলেন না। তিনি শাসনকার্যে উলেমাদের পরামর্শ সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে এবং তাদের ক্ষমতা ধ্বংস করার জন্য তাদের সীমা নির্দিষ্ট করে দেন। শরিয়তি’ করব্যবস্থা বাতিল করে তিনি বিভিন্ন নতুন কর আরােপ করেন।
অভিজাতদের দমন
অভিজাতদের কাজকর্ম রাষ্ট্রবিরােধী হলেও আলাউদ্দিনের পূর্ববর্তী সুলতানরা তাদের বিরুদ্ধে কোনাে ব্যবস্থা নেননি। কিন্তু আলাউদ্দিন খলজি অভিজাতদেরকঠোরভাবে দমন করার নীতি গ্রহণ করেন। তিনি অভিজাতদের তার অনুগত ভৃত্য বলে মনে করতেন। তিনি ঘােষণা করেন যে, কোনাে ব্যক্তি বা গােষ্ঠীর স্বার্থে নয়, রাষ্ট্র সবসময় তার নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী চলবে।
প্রয়ােজনভিত্তিক ধর্মনিরপেক্ষতা
আলাউদ্দিন খলজি শাসনব্যবস্থায় উলেমাদের প্রতিপত্তি ধ্বংস করলেও বা শরিয়তের বিধান অনুসারে দেশশাসন না করলেও তাকে সম্পূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষ শাসক বলা যায় না। নিজ স্বৈরক্ষমতাকে কার্যকরী করার জন্যই তিনি শাসনকার্যে উলেমাদের হস্তক্ষেপের বিরােধিতা করেন। হিন্দুদের বিরুদ্ধে তিনি উলেমাদের পরামর্শ গ্রহণ করতেন। তাই তাঁর ধর্মনিরপেক্ষতা ছিল প্রয়ােজনভিত্তিক। ড. আর. পি. ত্রিপাঠী বলেছেন যে, আকবরকে যে অর্থে ধর্মনিরপেক্ষ বলা যায়, আলাউদ্দিনকে সেই অর্থে ধর্মনিরপেক্ষ বলা যায় না। কারণ আলাউদ্দিনের ধর্মনিরপেক্ষতারধারণা ছিল প্রয়ােজনভিত্তিক, আদর্শভিত্তিক নয়।
মূল্যায়ন
সীমাহীন স্বৈরক্ষমতার অধিকারী শাসক হিসেবে আলাউদ্দিন তার রাজতান্ত্রিক আদর্শ গড়ে তােলেন। তিনি আপাতদৃষ্টিতে ধর্মনিরপেক্ষ নীতি গ্রহণ করলেও মধ্যযুগের কালসীমার উর্ধ্বে নিজেকে তুলে ধরতে পারেননি। কেননা সীমাহীন স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং সাধারণ মানুষকে ক্রীতদাসে পরিণত করাই ছিল তার রাজতান্ত্রিক আদর্শের মূলকথা।
আরো পড়ুন :-
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .