পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রভাবে ঊনবিংশ শতকে বাংলায় তথাকথিত যে নবজাগরণ দেখা দেয়, তার অন্যতম বার্তা বহনকারী মহাপুরুষ ছিলেন রাজা রামমােহন রায়। এই সময় ধর্ম ও সমাজ জীবনে প্রবল ভাবাবেগ ও আন্দোলনের সূচনা হয়। সে সময় যে সকল মনিষী উপলব্ধি করেন যে, পাশ্চাত্যের বিজ্ঞান, দর্শন, মানবতাবাদ ও যুক্তিবাদকে আশ্রয় করে ভারতের সমাজের অবক্ষয় রদ করা সম্ভব। রামমােহন রায় ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম। তার বহুমুখী প্রতিভা ঋষিসুলভ দূরদৃষ্টিও নিরলস প্রচেষ্টার ফলে বাংলায় এক নবযুগের সৃষ্টি হয়। আর এই জন্য তাঁকে বাংলার নবজাগরণের পথিকৃৎ বলা হয়।
যুক্তিবাদ প্রতিষ্ঠা
রামমােহনই সর্বপ্রথম বাংলা তথা ভারতবর্ষে অন্ধ বিশ্বাসের স্থলে যুক্তিবাদ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন এবং সারাজীবন কুসংস্কার ও রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছিলেন।
সামাজিক সংস্কার
কুসংস্কার ও জড়ত্বের গ্রাস থেকে সমাজকে মুক্ত করার কাজে তিনি ব্রতী হন। তৎকালীন হিন্দু সমাজে প্রচলিত ঘৃণ্য কুসংস্কারগুলি যেমন— -বহুবিবাহ, বাল্য বিবাহ, কৌলিন্যপ্রথা, সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে সােচ্চার হন। হিন্দু ধর্মের বিভিন্ন শাস্ত্র অধ্যয়ন করে তিনি প্রমাণ করেন যে, সহমরণ প্রথা একটি ধর্মবিরােধী কাজ। তৎকালীন বড়লাট লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক রামমােহনের সহায়তায় ১৭নং রেগুলেশন দ্বারা ১৮২৯ খ্রিঃ সহমরণ প্রথম রদ করেন।
শিক্ষা সংস্কার
পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রবর্তনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে রামমােহন বাংলার নবজাগরণের পথ সুগম করেন। তিনি ইংরাজী শিক্ষার প্রসারের জন্য ১৮১৬ খ্রিঃ নিজ ব্যয়ে অ্যাংলাে হিন্দু স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। এই কলেজে পাশ্চাত্য সমাজবিজ্ঞান ও পদার্থবিদ্যা শিক্ষা দেওয়া হত। ১৮২৩ খ্রিঃ লর্ড আমহার্স্টকে লিখিত এক পত্রে তিনি ভারতবর্ষে গণিত, প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, রমায়ণ, অস্থিবিদ্যা ও পাশ্চাত্য দর্শন শিক্ষা দেবার দাবি জানান। তার লিখিত এই পত্রটি ভারতীয় নবজাগরণের ইতিহাসে এক মূল্যবান দলিল।
রাজনৈতিক চিন্তা
রামমােহনকে আধুনিক চিন্তাধারার জনক বলা হয়ে থাকে। তিনি ক্ষমতা বিভাজন নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি শাসনতান্ত্রিক উপায়ে রাজনৈতিক অভিযােগ দূরীকরণের যে ইঙ্গিত তিনি দিয়েছিলেন তাকে অনুসরণ করেই পরবর্তীকালে গড়ে উঠেছিল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস। তাই ডঃ বিধানচন্দ্র বলেন, রামমােহন ভারতে নবজাগ্রত জাতীয়তাবাদের অন্যতম প্রতিভূ হয়ে উঠেছিলেন।
মূল্যায়ণ
রামমােহন রায় বাংলার নবজাগরণের পথিকৃৎ ছিলেন ঠিকই, কিন্তু তার কার্যের মধ্যে কিছু স্ববিরােধ ছিল। অনেকে বলেন, তিনি স্বয়ং কুসংস্কারের উদ্ধে যেতে পারেননি। তিনি সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে যতটাই সােচ্চার ছিলেন, ততটাই নীরব ছিলেন বহুবিবাহ ও জাতিভেদ প্রথার বিষয়ে। তিনি নিজেই উপবীত ধারণ করে আধুনিক মনস্কতার পরিচয় দেননি। আসলে রামমােহন ছিলেন সংস্কারক বিপ্লবী নন। তাই নিজ ধর্ম ও রীতিকে তিনি বিসর্জন দিতে পারেননি। অতএব তার আধুনিক ভারত গঠনের কথা স্মরণে রেখে তাকে বাংলার নবজাগরণের পথিকৃৎ বলা যেতে পারে।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .