১৮৫৭-র মহাবিদ্রোহের তাৎপর্য
১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দের মহাবিদ্রোহব্যর্থ হলেও নিস্ফল ছিল না। মহাবিদ্রোহের আপাত উদ্দেশ্য অপূর্ণ থেকে গেলেও ভারতের ইতিহাসে মহাবিদ্রোহকেদিক চিহ্ন বলা অপ্রাসঙ্গিক নয়। বিদ্রোহের ঝড় থেকে ব্রিটিশ শাসন আপাতত রক্ষা পেলেও ভারতে ব্রিটিশ শাসনের নতুন ভিত্তি গঠনের প্রয়ােজন দেখা দেয়। সেজন্যই স্যার লেপেল গ্রিভিন মন্তব্য করেছেন “মহাবিদ্রোহ ভারতের আকাশ থেকে বহু মেঘ দূরে সরিয়ে দেয়।”
১) কোম্পানীরশাসনের অবসান
সিপাহী বিদ্রোহ কোম্পানীর শাসনের মৃত্যুঘন্টা ধ্বনিত করে। ভারতের শাসনভার কোম্পানীর হাতে না রেখে ব্রিটিশ সরকারের হাতে নেওয়ার দাবিতে ইংল্যান্ডের জনমত সরব হয়। ১৮৫৬ খ্রিঃ ভারত শাসন আইন দ্বারা ভারতের শাসনভার ইংল্যান্ডের মহারাণীর উপর বর্তায় ও কোম্পানীর শাসনের অবসান হয়। কীথ এই ক্ষমতা হস্তান্তরকে “more nominal than real” বলে অভিহিত করেছেন।
২) মহারাণীর ঘােষণাপত্র
১৮৫৮ খ্রিষ্টাব্দের ১লা নভেম্বর মহারাণী ভিক্টোরিয়া এক ঘােষণাপত্র জারী করেন। এতে i) দেশীয় রাজাদের সাথে কোম্পানীর চুক্তিগুলি ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক পালন; ii) দেশীয় রাজাদের অধিকার, সম্মান, মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখা; iii) ভারতের ধর্ম ও সামাজিক ব্যাপারে সরকারের হস্তক্ষেপ না করা; iv) জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সরকারী চাকুরিতে নিযুক্ত হওয়ার অধিকার দান প্রভৃতি প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।
৩) প্রশাসনিক পরিবর্তন
শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তনের লক্ষ্যে কিছু আইন ও সনদ আইন পাশ করা হয়। ১৮৩৩ খ্রিষ্টাব্দে পাস হওয়া সনদ আইনে যে কেন্দ্রীকরণ নীতির প্রস্তাব ছিল ১৮৬১ খ্রিঃ এক কাউন্সিল আইন পাস করে তা বাতিল করা হয়। পরিবর্তে প্রশাসনকে জাতীয়করণ ও বিকেন্দ্রীকরণের চেষ্টা করা হয়। বােম্বাই ও মাদ্রাজ কাউন্সিলকে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা দান করা হয়। বড়লাটকে সাহায্য করার জন্য ৫ সদস্য বিশিষ্ট এক কার্যনির্বাহক পরিষদ গঠনের কথা বলা হয়।
৪) অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পুনর্গঠন
১৮৫৭ খ্রিঃ বিদ্রোহ দমনের জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় হয়। তার ফলে আর্থিক ঘাটতি দেখা দেয়। এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা পুনর্গঠনের প্রশ্ন বিশেষ গুরুত্ব লাভ করে। তাই ১৮৫৯ সালে জেমউইলসন গভর্ণর জেনারেলের সদস্য হিসাবে দায়িত্বভার গ্রহণ করে তিনি বেশ কিছু অর্থনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তিনি আয়কর প্রবর্তন করেন, সমস্ত দ্রব্যের উপর ১০ শতাংশ আমদানি শুল্ক বসান, কাগজের নােট চালু করেন এবং কর্মচারীর সংখ্যা হ্রাস করে ব্যয় হ্রাস করার পরিকল্পনা করেন। উইলসনের হঠাৎ মৃত্যু হওয়ায় পরবর্তী অর্থনৈতিক সদস্য স্যামুয়েল লেইং উইলসনের নীতি অব্যাহত রাখেন এবং তার পরিকল্পনা কার্যকর করেন।
৫) দেশীয় রাজাদের সহযােগিতার নীতি গৃহীত
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে মজবুত করার জন্য দেশীয় রাজাদের সহযােগিতার নীতি গৃহীত হয়। ক্যানিং দেশীয় রাজাদের “Back waters in a storiny sea” বলে আখ্যা দেন। দেশীয় রাজাদের নানারকম খেতাব দেওয়া হয়। দেশীয় রাজাদের তাদের রাজ্যশাসনের অধিকার দেওয়া হয়। দেশীয় রাজারা ব্রিটিশ শাসনের ‘Subordinate Partner’-এ পরিণত হয়।
৬) সামরিক সংস্কার
সিপাহী বিদ্রোহের ব্যাপকতা ও তীব্রতা দেখে ব্রিটিশ সামরিক বিভাগকে আরাে শক্তিশালীকরার উদ্যোগ নেয়। ভারতে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে ইংরেজ ও ইউরােপীয় সেনার সংখ্যা বাড়ানাে হয়। শ্বেতাঙ্গ সেনার সংখ্যা ৪৫,০০০ থেকে বাড়িয়ে ৬৫,০০০ করা হয়। আর ভারতীয় সেনার সংখ্যা ২ লক্ষ ৩৮ হাজার থেকে কমিয়ে ১ লক্ষ ৪০ হাজার করা হয়। গােলন্দাজ বাহিনীতে ভারতীয় সৈন্য নিয়ােগ বন্ধ হয়। ভারতীয় জনগণের কাছ থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে যথাসম্ভব বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয় এবং সেনা শিবিরে জাতীয়তাবাদী সংবাদপত্র ও পুস্তক-পুস্তিকা প্রবেশ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়।
পরিশেষে বলা যায় ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দের মহাবিদ্রোহের ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী। After Mass of the Revolt গ্রন্থে চার্লস মেটকাফ বলেছেন যে, শাসক ও শাসিতের মধ্যে বর্ণজনিত ব্যবধান মহাবিদ্রোহের অব্যবহিত পরে অঘােষিত যুদ্ধের রূপ নেয়। মানবিক সম্পর্কের এই অবনমনই মহাবিদ্রোহের প্রধান উত্তরাধিকার।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .