ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান
প্রচলিত অর্থে একজন সাধারণ সংস্কৃত পন্ডিত হয়েও সমাজ সচেতন ও মানবতাবাদী ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-৯১ খ্রীঃ) ছিলেন বঙ্গীয় নবজাগরণের এক জলন্ত প্রতিমূর্তি। উনবিংশ শতাব্দী বাংলা তথা ভারতের জাতীয় জীবনের এক গৌরবময় যুগ। এই শতাব্দীর প্রায় প্রারম্ভকাল হতে পাশ্চাত্য শিক্ষা ও জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চা বাঙালীর প্রতিভা দীর্ঘকালব্যাপী প্রচলিত সামাজিক ও ধর্মীয় কুসংস্কারের শৃঙ্খলমুক্ত হয়ে বৈজ্ঞানিক ও মানবিক যুক্তিবাদের আলােকে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। বাংলার এই অভিনবযুগের প্রথম ব্যক্তি ছিলেন রামমােহন। তাঁর একজন প্রকৃত উত্তরসূরী ছিলেন বিদ্যাসাগর। বিদ্যাসাগরের চরিত্রের দৃঢ়তা সম্পর্কে বিস্ময় প্রকাশ করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেনঃ “আমাদের এই অবনমিত দেশে ঈশ্বরচন্দ্রের মত এমন অখন্ড পৌরুষের আদর্শ কেমন করিয়া জন্ম গ্রহণ করিল একই সুরে রামেন্দ্র সুন্দর ত্রিবেদী বলেছেন ঃ এই দেশে এই জাতির মধ্যে বিদ্যাসাগরের মত একটা কঠোর মানুষের আবির্ভাব। ঐতিহাসিক ঘটনা রূপেই গণ্য হবে।”বস্তুতই বিদ্যাসাগরের চরিত্র ছিল কোমলতার সাথে কাঠিন্যের গ্রহণের সাথে ত্যাগের প্রাচ্যের সাথে পাশ্চাত্যের ভাবাদর্শের এক অপূর্ব সমন্বয়। মাইকেল মধুসূদন যথার্থই বলেছেন – Vidyasagar lad the gents genius and wisdom of an ancient sage the energy of an Englishman and the heart of a Bengali mother.”
ছাত্রজীবন ও কর্মজীবনের সূত্রপাত
১৮২০ খ্রীষ্টাব্দের ২৯ সে সেপ্টেম্বর মেদিনীপুর জেলার (তৎকালীন হুগলী জেলা) বীরসিংহ গ্রামে এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর জন্ম গ্রহণ করেন। তার পিতা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন সৎচরিত্র নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ এবং মা ভগবতী ছিলেন একজন দৃঢ়চেতা নারী। আত্মবিশ্বাস ও তেজস্বিতার মূর্ত প্রতীক ঈশ্বরচন্দ্রের জীবনে তার দরিদ্র পিতা ও মাতার প্রভাব ছিল অপরিসীম। বিনয় ঘােষ লিখেছেন – “মা ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্রের জীবনে ডাইনামাে। পিতা ঠাকুরদাস ছিলেন তার টিচার ও ট্রেনার।” গ্রামের পাঠশালায় লেখাপড়ার পাঠ সাঙ্গ করে মেধাবী বালক ঈশ্বরচন্দ্র দরিদ্র পিতার হাত ধরে নদ-নদী পেরিয়ে পদব্রজে উপস্থিত হলেন নবভারতের রাজধানী শহর কলকাতায়। ১৮২৯ খ্রিষ্টাব্দের ১ লা জুন তিনি সংস্কৃত কলেজে ভর্তি হন। ১৮৩৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বিদ্যাসাগর উপাধি লাভ করেন এবং ১৮৪১ খ্রিষ্টাব্দে শিক্ষাজীবন শেষ করে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের বাংলা বিভাগের প্রধান পন্ডিত পদে যােগদান করেন। ১৮৫০ খ্রীষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে তিনি সংস্কৃত কলেজে অধ্যাপক এবং পরে ঐ কলেজের অধ্যক্ষ পদে নিযুক্ত হন (২২ শে জানুয়ারী ১৮৫১ খ্রীঃ) ১৮৫৮ খ্রীষ্টাব্দের ৩রা নভেম্বর পর্যন্ত অর্থাৎ মােট আট বৎসর তিনি সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন।
শিক্ষা সংস্কার
ইতিমধ্যে ঈশ্বরচন্দ্র শিক্ষা বিস্তার এবং বিশেষ করে স্ত্রী শিক্ষা বিস্তারের প্রচেষ্টায় নিজেকে নিযুক্ত করেন। তিনি তত্ত্ববােধিনী পত্রিকায় বিবিধ বিষয়ে সংস্কারধর্মী প্রবন্ধ প্রকাশ করে তার প্রগতিশীল মনােভাবের পরিচয় দেন। সংস্কৃত কলেজে দায়িত্বভার গ্রহণের পর তিনি কলেজের শিক্ষাব্যবস্থায় মৌলিক পরিবর্তন সাধন করেন। ঈশ্বরচন্দ্র ঐ কলেজের দ্বার সকল শ্রেণির হিন্দুর জন্য মুক্ত করে এক সামাজিক বিপ্লবের সূচনা করেন। তিনি সংস্কৃত কলেজের পাঠক্রমে পরিবর্তন আনয়ন করে মৌলিক প্রতিভার পরিচয় দেন। তিনি শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে যে সংস্কার সাধন করেন তার একটি বিশেষ লক্ষ্য ছিল। তিনি মনে করতেন যে ভারতীয়দের শিক্ষার লক্ষ্য হবে সংস্কৃত ও ইংরাজী ভাষায় দক্ষতা অর্জন। করে নিজ নিজ মাতৃভাষাকে সমৃদ্ধ করা। এই লক্ষ্যে পৌঁছাবার জন্য তিনি সংস্কৃত শিক্ষার মত ইংরেজি শিক্ষার উপরও বিশেষ গুরুত্ব আরােপ করেছিলেন। বিদ্যাসাগর নিজে গােড়া ব্রাম্মন বংশে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি পাশ্চাত্য জ্ঞান বিজ্ঞানকে সাদরে গ্রহণ করেছিলেন।
শিক্ষা বিস্তারে বিবিধ উদ্যোগ
বিদ্যাসাগর মহাশয় বাংলা শিক্ষার উন্নয়ন ও প্রসারকল্পে কর্ম তৎপর হন। জনশিক্ষাবিস্তারের কাজে তিনি অগ্রহণী ভূমিকা পালন করেন। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে শিক্ষাই অন্ধকার দূর করে মানুষকে প্রকৃত মনুষ্যত্বে পৌঁছে দেয়। এক চিঠিতে তিনি লেখেন যে – “জনসাধারণের মধ্যে শিক্ষাবিস্তার এই এখন আমাদের প্রয়ােজন। আমাদের কতগুলি বাংলা স্কুল স্থাপন করতে হবে এবং এইসব স্কুলের জন্য প্রয়ােজনীয় ও শিক্ষাপ্রদ বিষয়ের অনেকগুলি পাঠ্যপুস্তক রচনা করতে হবে।” বাংলার বিভিন্ন জেলায় তিনি ২০ টি মডেল স্কুল বা আদর্শ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। শিক্ষক শিক্ষণের উদ্দেশ্যে সংস্কৃত কলেজের অভ্যন্তরেই তিনি একটি নর্মাল স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। এর পরিচালনার দায়িত্ব ছিল অক্ষয়কুমার দত্ত ও মধুসূদন বাচস্মৃতির উপর। ১৮৪৯ খ্রীষ্টাব্দে ড্রিঙ্ক ওয়াটার বেথুনের পৃষ্ঠপােষকতায় হিন্দু বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৫০ খ্রিষ্টাব্দে বিদ্যাসাগর এই শিক্ষায়তনের সম্পাদকের পদ গ্রহণ করেন। তাঁর উদ্যোগে গ্রামাঞ্চলে ৩৫টিবালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। শিবনাথশাস্ত্রী তার আত্মচরিত এ লেখেন যে উনিশ শতকের শেষভাগে বেসরকারি উদ্যোগে বাংলায় যে সব কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তাদের সকলেরই ধ্রুবতারা ছিল মেট্রো পলিটন কলেজ। কেবল শিক্ষাবিস্তারই নয় — বিরাট পান্ডিত্য সত্ত্বেও তিনি জনশিক্ষার জন্য বেশ কিছু পাঠ্য পুস্তক রচনা করেন। এগুলির মধ্যে বর্ণমালা, কথামালা, নীতিবােধ, চরিতাবলী, বােধােদয় উল্লেখযােগ্য।
সমাজ সংস্কারক হিসাবে
উনবিংশ শতাব্দীতে ভারতীয় সমাজ নানাবিধ কুসংস্কারে সমাচ্ছন্ন ছিল। পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সভ্যতার প্রথম প্লাবনে সমাজ ব্যবস্থা বিপর্যস্তও সংশয় সকুল হয়ে পড়ে।এই অবস্থায় রাজা রামমােহন রায় দেশের পথ নির্দেশ করেন। সামাজিক সংস্কারের মূল উচ্ছেদ করে তিনি সমাজের আমূল পরিবর্তনের চেষ্টা করেন। ইতিমধ্যে পুন ভাবধারা, নূতন ধরণের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জীবন ও ইংরেজ শাসন সব মিলিয়ে ভারতীয়দের সামাজিক জীবনে গভীর পরিবর্তন সূচিত হয়। এর প্রভাব প্রথমে অনুভূত হয় শহরাঞ্চলে। পরে গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। এতে প্রচলিত প্রাচীন পন্থী সামাজিক, রাজনৈতিক ও জাতিভেদ প্রথা অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়েছিল। কিন্তু সামাজিক কুসংস্কারগুলি যথাযথ বজায় ছিল। সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়। ১৮২৯ খ্রীঃ লর্ড বেন্টিঙ্ক আদেশ জারি করে সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ বলে ঘােষণা করেন। কিন্তু শিশু ও বালিকার বিবাহ, কন্যা বিক্রয়, পুরুষের বহু বিবাহ, বিধবা বিবাহে বাধা প্রভৃতি কুসংস্কারগুলি থেকে যায়।
কোম্পানীর শাসনকালে সমাজ সংস্কার আন্দোলনের মূল বিষয় ছিল নারী মুক্তি। সতীদাহ প্রথা রহিত হবার ফলে বিধবা বিবাহ ও নারী মুক্তি আন্দোলন শক্তি সঞ্চয় করে। কিন্তু নারীমুক্তি আন্দোলন ও বিধবা বিবাহ প্রবর্তনকে যিনি জীবনের শ্রেষ্ঠতমব্রত হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন তিনি হলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। বাল্যে যখন তিনি কলকাতায় আসেন। তখন সতীদাহ প্রথা আইনত নিষিদ্ধ হয়েছে, তারপর বেশ কয়েক বৎসর কেটে গেছে। উচ্চবর্ণ হিন্দুদের মধ্যে বিধবা বিবাহ নিয়ে বাদানুবাদের সূত্রপাত হয়েছে। বিদ্যাসাগর। তত্ত্ববােধিনী পত্রিকাতে বিধবাদের পুর্নবিবাহের প্রয়ােজনীয়তা সম্বন্ধে দীর্ঘ প্রবন্ধ লেখেন। তার প্রবন্ধ পড়ে স্বপক্ষে মত তৈরী হয়। এর পরে তিনি বিধবা হিন্দু শাস্ত্রানুমােদিত বলে প্রমাণ করে একটি পুস্তক প্রকাশ করেন। বিদ্যাসাগর বুঝতে পারলেন সরকারি সাহায্য ছাড়া বিধবা বিবাহ প্রবর্তন করা যাবে না, কারণ জনমত কে শক্তিশালী করবার জন্য আইনেরও প্রয়ােজন আছে। বিধবা বিবাহের সমর্থনে তিনি প্রায় এক হাজার গণ্য মান্য ব্যক্তির স্বাক্ষরিত এক আবেদনপত্র বড়লাটের নিকট পাঠান। গোঁড়া হিন্দু নেতারা তা জানতে পেরে প্রায় ৩৭ হাজার জনের স্বাক্ষরিত এক প্রতিবাদপত্র বড়লাটের নিকট পেশ করেন। বিরােধী পক্ষ বিদ্যাসাগরের বিরুদ্ধে এরূপ আন্দোলন শুরু করেন যে, তার জীবন। বিপন্ন হবার আশঙ্কা দেখা দেয়। কিন্তু তার নিরলস প্রচেষ্টার ফলে ১৮৫৫ খ্রীঃ ভারত সরকার হিন্দু বিধবা আইন সিদ্ধ বলে ঘােষণা করলেন এবং এ বিষয়ে একটি আইন ও বিধিবদ্ধ করা হল।
বাংলা ভাষার আধুনিকীকরণ
আধুনিক বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিকাশে বিদ্যাসাগরের ভূমিকা স্মরণীয়। তিনি নিজের রচনাবলীর মধ্যেও আধুনিক বাংলা গদ্যরীতির বিবর্তনে পথিকৃতের কাজ করেন। ইতিপূর্বে বাংলাভাষা ছিল সম্পূর্ণভাবে সংস্কৃত ভাষা প্রভাবিত। অলংকারবহুল বাংলা ভাষা স্বভাবতই ছিল জটিল ও অবােধ্য। বিদ্যাসাগর বাংলা ভাষাকে যথাসম্ভব সংস্কৃত প্রভাব মুক্ত করে স্বান্ত্রদান করতে প্রয়াসী হন। তিনি নতুন ছন্দে বাংলা গদ্য রচনা করে বাংলা ভাষাকে অনেক বেশী সহজ ও সরল করে দেন। এরই উপর ভিত্তি কবে পরবর্তীকালে আধুনিক বাংলা ভাষার বিবর্তন ঘটেছে। গদ্য রচনার ছেদ চিহ্নের প্রয়ােগ তার অনন্য কীর্তি। সেই সঙ্গে পদর্বিন্যাস দ্বারা বাংলা রচনাকে সাবলীল করে দেন।
উপসংহার
এই মহামানব ঈশ্বরচন্দ্র তার মানবতাবাদ কপটবর্জিত ব্যবহার, দীন, দরিদ্র ও নির্যাতিতদের জন্য অপার করুণা সরল ও অনাড়ম্বর জীবনযাত্রা এবং ন্যায় ও সত্যের জন্য দ্বিধাহীন সংগ্রামের প্রতিমূর্তিরূপে ভারতবাসীর হৃদয়েচিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। ডঃ অমলেশ ত্রিপাঠী তাকে “ঐতিহ্যবাদী আধুনিকতাবাদের প্রবক্তা” বলে অভিহিত করেছেন; কারণবিদ্যাসাগরের মধ্যে ভারতের সনাতন শাশ্বতআদর্শেরসঙ্গে আধুনিকতার সমন্বয় ঘটেছিল। অপরদিকে অশােক সেন এর মতে বিদ্যাসাগরের আধুনিকতা হল বিকৃত আধুনি’ তার মতে ঔপনিবেশিক শাসনের পরিকাঠামাের মধ্যে তার সকল আধুনিক ও প্রগতিশীল সংস্কার প্রচেষ্টা মায়া মরীচিকার মতাে মিলিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এসত্ত্বেও সমকালীন বাংলার ইতিহাসে বিদ্যাসাগরের ভূমিকাঅতি গুরুত্বপূর্ণ।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .