ওয়াহাবি আন্দোলন
উনবিংশ শতকের প্রথমদিকে ভারতে ওয়হাবী আন্দোলনের সূচনা হয়। প্রথমদিকে এই আন্দোলন ছিল ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন এবং ধর্ম সম্মত ভাবে মুসলীম সমাজকে গড়ে তােলাই ছিল এর প্রধান লক্ষ্য। এর বাণী ছিল ইসলাম ধর্ম ও সমাজকে কলুষতা থেকে মুক্ত করা ও হজরত মহম্মদের আদর্শ অনুসরণ করা। ভারতবর্ষে ওয়াহাবী আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন রায়বেরিলির সৈয়দ আহম্মদ। ১৮২০ খ্রঃ থেকে সৈয়দ আহম্মদ আরবের ওয়াহাবীদের অনুকরণে ধর্মীয় সংস্কারের প্রচার করতে শুরু করেন।
বৈশিষ্ট্য
সৈয়দ আহম্মদ তার অনুগামীদের বিশুদ্ধ ইসলাম ধর্ম পালনের আহ্বান জানিয়েছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে তাদের কাছে তিনি ইংরেজ বিতাড়নেরআদর্শও তুলে ধরেছিল। কারণ সৈয়দ আহম্মদের মতে ইংরেজ শাসিত ভাবত ‘দার-উল-হার্বে’ পরিণত হয়েছে। একে পুনরায় ‘দার-উল-ইসলামে’ পরিণত করার জন্য তিনি ইংরেজদের বিতাড়িত করতে চেয়েছিলেন। সুতরাং ধর্মসংস্কার আন্দোলন রূপে শুরু হলেও ওয়াহাবীদের ইংরেজবিতাড়নের লক্ষ্য আন্দোলনকে একটি রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য দান করেছিল।
(১) ইংরেজদের বহিস্কৃত করতে মুসলিমরা হিন্দুদেরও সামিল করে। ইংরেজ বিতাড়নের জন্য সৈয়দ আহম্মদ মারাঠা নায়ক হিন্দুরাওদের সাহায্য প্রার্থনা করেছিলেন।
(২) সৈয়দ আহম্মদের নির্দেশে ভারতের বিভিন্ন জায়গায় ওয়াহাবীদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তােলা হয়েছিল। সেখানে তারা ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই-এর জন্য তালিম নিত।
(৩) ওয়াহাবী আন্দোলনের প্রধান অস্ত্র ছিল কৃষক। সেজন্য কৃষকদের উপর নির্যাতনকারী মহাজন, জমিদার, নীলকর সাহেব প্রভৃতি আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য বস্তু হয়েছিল। অবশ্য এই বৈশিষ্ট্যটি তিতুমীরের নেতৃত্বে পরিচালিত বাংলার ওয়াহাবী আন্দোলনেই সবচেয়ে বেশী প্রতিফলিত হয়েছিল।
সৈয়দ আহম্মদ
সৈয়দ আহম্মদ উত্তর ভারতের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে তার মতবাদ প্রচার করেছিলেন। যার ফলে বাংলা, বিহার ও উত্তরপ্রদেশের নানা জায়গায় ওয়াহাবী সংগঠন গড়ে উঠেছিল। ওয়াহাবী সংগঠন গড়ে তােলার ব্যাপারে তার দুই শিষ্য বিলায়েৎ আলি ও এনায়েৎ আলি উল্লেখযােগ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। একসময় তিনি নিজেই নেতৃত্ব দিয়ে উত্তর পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চলে সামরিক প্রস্তুতি শুরু করেছিলেন তার অনুগামীদের নিয়ে, মুসলীম যুবকদের নিয়ে তিনি যে মুজাহেৎবাহিনী গঠন করেছিলেন তাদের ইউরােপীয় কায়দায় সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই করবার মতন উপযুক্ত করে তােলা হয়েছিল। ইংরেজশাসিত ভারতবর্ষ ‘দার-উল-হার্বে’ পরিণত হয়েছে বলে মনে করে সৈয়দ আহম্মদ ভারত ত্যাগ করে উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে পাঠান অধ্যুষিত এলাকায় বসবাস করতে থাকেন এবং সেখানে সামরিক বাহিনী গড়ে তুলে তিনি ভারতে ইংরেজ শাসকদের দেশ থেকে বিতাড়নের পরিকল্পনা করেছিলেন। উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে সামরিক প্রস্তুতি কালে পাঞ্জাবের শিখদের সঙ্গে ওয়াহাবীদের সংঘর্ষ শুরু হয়ে যায়। ১৮৩১ খ্রীঃ বালাকোটের যুদ্ধে সৈয়দ আহম্মদ নিহত হয়। ঐ বছরই তার অনুগামী তিতুমীর ইংরেজদের বিরুদ্ধে বারাসত বিদ্রোহ করেছিল।
তিতুমীর
বাংলার ওয়াহাবী আন্দোলনের নেতা ছিলেন তিতুমীর। তার প্রকৃত নাম ছিল মীর নিশার আলি। তিতুমীরের নেতৃত্বে বাংলার ওয়াহাবী আন্দোলনের লক্ষ্যই ছিল কৃষকদের উপর অত্যাচারী জমিদার, নীলকর, মহাজন এবং এদের পৃষ্ঠপােষক ইংরেজ শাসকরা কৃষকদের দুরবস্থার জন্য দায়ী এই সব লােকদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে তিতুমীর হিন্দু-মুসলীম উভয় কৃষকদেরই সমর্থন লাভ করেছিলেন। তিতুমীরের বক্তব্যে অনুপ্রাণিত হয়ে চব্বিশ পরগণা ও নদীয়ার হাজার হাজার কৃষক তাদের অনুগামী হয়ে পড়েছিল। তিতুমীরের শক্তিবৃদ্ধিতে ভীত হয়ে জমিদাররা তার গর্বকে খর্ব করার জন্য প্রস্তুত হয়েছিল। শুরু হয়েছিল এলাকার ওয়াহাবীদের উপর জমিদারের চরম নির্যাতন। পুরার জমিদার। কৃয়দেব রায়ের বিরুদ্ধে তিনি বিদ্রোহ করেন। কারণ কৃয়দেব রায় তার পুরার জমিদারী এলাকায় বসবাসকারী প্রত্যেকের উপর আড়াই টাকা করে দাড়ি কর ধার্য করেছিলেন। পুরার জমিদারের এই ধরনের দমন মূলক ও অপমানজনক ব্যবহারের বিরুদ্ধে তিতুমীর অনুগামীরা প্রতিরােধ আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। শুরু হয়েছিল অত্যাচারী জমিদারদের উপর হামলা। ক্রমশঃ তিতুমীরের আন্দোলন সরকার বিরােধী সশস্ত্ররূপ ধারণ করে। প্রধান মন্ত্রী মইনুদ্দিন সেনাপতি গােলাম মাসুদের সাহায্যে নাড়কেল বেড়িয়ার বাঁশের কেল্লা তৈরী করে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা করে। অবশেষে বেন্টিঙ্কের আদেশে এক সুসজ্জিত ইংরেজ বাহিনী তিতুমীরের বিরুদ্ধে অগ্রসর হয়। গােলার আঘাতে নারকেল বেড়িয়ার কেল্লা বিধ্বস্ত হয়। তিতুমীর নিহত হন এবং তাঁর ৩৫০ জন সহকর্মী বন্দী হন।
প্রকৃতি
ডঃ রমেশ চন্দ্র মজুমদারের মতে এই আন্দোলন সাম্প্রদায়িকতা মুক্ত ছিল না এবং এটি জাতীয় সংগ্রামও ছিল না। মুসলমান সাম্রাজ্য গড়ে তােলার এ ছিল একটি সংকীর্ণ প্রচেষ্টা। ডঃ মজুমদার এই আন্দোলনকে “It was a movement of the Muslims by the Muslims and for the Muslims”বলে অভিহিত করেছেন। কিন্তু ডঃ কুয়েমুদ্দিন আহমেদের মতে ওয়াহাবী আন্দোলনকে সাম্প্রদায়িকতাবাদী আন্দোলন বলা যায় না। কারণ এই আন্দোলন কেবলমাত্র মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। হিন্দুরাও ছিলেনএই আন্দোলনের সমর্থক। ওয়াহাবী আন্দোলন ছিল ভারত থেকে ইংরেজবিতাড়নের আন্দোলন। সেই অর্থে এই আন্দোলনকে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন বলা চলে। স্মিথের মতে এই আন্দোলন ছিল পূর্ণ মাত্রায় শ্রেণি সংগ্রাম।
ওয়াহাবী আন্দোলন ব্যর্থ হয় বটে। কিন্তু তা সুদূর প্রসারী প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহ এই আন্দোলনে অনুপ্রেরণা পায়।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .