চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে জমিদারেরা জমির মালিক হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করেন। এটা নিঃসন্দেহে এক অভিনব ঘটনা। কিন্তু এরফলে জমিদারদের যে ষােলাে আনা লাভ হয়েছিল, তা কিন্তু নয়। আসলে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের ঠিক পরেই জমিদারদের লাভ থেকে ক্ষতিই হয়েছিল বেশি। কারণ তাদের অনেক ক্ষমতা কমে গিয়েছিল। জমিদারের কাছ থেকে কর্ণওয়ালিশ বিচার, পুলিশ ক্ষমতা প্রায় সবই কেড়ে নিয়েছিলেন। কিন্তু জমিদারদের সব থেকে বড় অভিযােগ ছিল সরকার কর্তৃক উচ্চহারে জমিদারি কর আদায়। ফিলিপ ফ্রান্সিস চেয়েছিলেন সরকারের প্রয়ােজনের দিকে তাকিয়ে রাজস্বের হার হােক। কিন্তু কর্ণওয়ালিশ তা করেননি।
অনেক জমিদার এই উচ্চহারে করের বিরুদ্ধে প্রতিবাদও জানিয়ে ছিলেন। সেখানকার কৃষি এত অনিশ্চিত যে তাদের পক্ষে সরকারি রাজস্ব ঠিকমতাে দেওয়া সম্ভব নয়। বর্ধমানের মহারাজা তেজচঁদ নিজে কলকাতায় এসে রাজস্ব হ্রাসের অনুরােধ জানিয়েছিলেন। বস্তুত রাজস্ব ব্যবস্থার প্রবর্তনের মধ্যেই যে বিরাট ত্রুটি থেকে গিয়েছিল, তাই অনেক জমিদারের পক্ষে বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। অবশ্য, কিছু কিছু জমিদারের ক্ষেত্রে সুবিধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। উপরন্তু সূর্যাস্ত আইন অনেক সহৃদয় জমিদারের সর্বনাশ ঘটিয়েছিল।
সূর্যাস্ত আইনের প্রথম তিন দশকে বাংলার প্রায় অর্ধেক জমিদারি হাত বদল হয়। অনেক উঁইফোড় জমিদারের সৃষ্টি হয়। অনেক জমিদার ব্যবসাবাণিজ্য বা চাকরিবাকরির দিকে ঝুঁকে পড়েন। বড় তরফের ঠাকুরপরিবারের জমিদার দর্পনারায়ণ ব্যবসার সঙ্গে সঙ্গে চন্দননগরে ফরাসিদের অধীনে চাকরি করতেন। লাহা, শীল বা মল্লিক পরিবারের লােকেরা প্রচুর ভূসম্পত্তির মালিক হয়েছিলেন বন্ধকি জমি দখল। করে। ঢাকার নবাব ও রাণাঘাটের পালচৌধুরী পরিবার ব্যবসা করেই জমিদারি জোগাড় করেছিলেন।
উপরিউক্ত ঘটনা থেকে লক্ষ করা যায় যে বাংলার অনেক পুরানাে জমিদার পরিবারের পতন ও নতুন জমিদার পরিবারের অভ্যুত্থান ঘটেছিল এই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে। অনেক ভালাে জমিদার প্রজাদের প্রকৃতপক্ষে মঙ্গলসাধন করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে নিজেরাও ধ্বংস হয়েছিলেন।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .