গুপ্তযুগের সমাজ ব্যবস্থা বৈশিষ্ট্য
গুপ্তযুগের সামাজিক অর্থনৈতিক বিষয় জানতে গেলে আমাদের তৎকালের স্মৃতিশাস্ত্রের উপর নির্ভর করতে হয়। যাজ্ঞবল্ক্য, নারদ, বৃহস্পতি ও ক্যাতায়ন এবং বাৎসায়নের কামসূত্র, মনুস্মৃতি চৈনিক পর্যটক ফা-হিয়েনের বিবরণ ও ধ্রুপদী সাহিত্যগুলি
এই সময়ের ইতিহাস রচনার অপরিহার্য উপাদান।
গুপ্তযুগে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের বিরুদ্ধে ব্রাহ্মণ্য প্রতিক্রিয়া সুদৃঢ় হয়েছিল। এর ফলে সামাজিক বর্ণ বিভাগ উপর ব্রাহ্মণ প্রাধান্য গভীর ভাবে পড়েছিল। এইসময় বিদেশীদের “ব্রাত্য ক্ষত্রিয়” রূপে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল।
চারিবর্ণ
গুপ্তযুগে হিন্দু সমাজ চারিটি বর্ণ বা শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল। যথা ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র। চতুরাশ্রম প্রথা সমাজে প্রচলিত ছিল। রাজা ছিলেন সমাজপতি। বিভিন্ন বর্ণের মধ্যে সংমিশ্রণ প্রতিরোধ করা শাসনকর্তাদের অন্যতম কর্তব্য বলে বিবেচিত হত। এই সময় অনেকগুলি সঙ্কর জাতির সৃষ্টি হয়েছিল। সমাজে ব্রাহ্মণরা শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করতেন এবং তাদের কর্তব্য ও আদর্শ সুনির্দিষ্ট ছিল। এই যুগে ব্রাহ্মণ মন্ত্রী ও গ্রন্থকারদেরও উল্লেখ পাওয়া যায়। সমকালীন স্মৃতি শাস্ত্রে অস্পৃশ্যতার অস্তিত্বের কথা জানা যায়। সমাজে পুলিবদ, শবর, কিরাত প্রভৃতি উপজাতিগণ বাস করত। ক্ষত্রিয়গণকে দ্বিজের সন্মান দেওয়া হত।
বিবাহ
সমাজে বর্ণভেদ প্রথা কঠোর হলেও বিভিন্ন বর্ণের মধ্যে বিবাহ প্রথা প্রচলিত ছিল। বহু বিবাহ সমাজে প্রচলিত ছিল। ব্রাহ্ম, দৈব, আর্য প্রজাপত্য, গান্ধর্ব, অসুর, রাক্ষস পৈশাচ। এই ৮ প্রকার বিবাহ প্রচলিত ছিল। মেয়েদের বাল্য বিবাহই অভিপ্রেত ছিল। তবে অনেক ক্ষেত্রে যৌবনা লাভের পর তাদের বিবাহ হত।
নারী স্থান
গুপ্তযুগে “স্ত্রী ধনের” উল্লেখ পাওয়া যায়। সমাজে সতীপ্রথা প্রচলিত ছিল। উচ্চ পরিবারে নারী শিক্ষার প্রচলন ছিল। স্বয়ম্বর প্রথা প্রচলিত ছিল। কিন্তু মেয়েদের বিবাহিত জীবন সুখকর ছিল না। দেবদাসীদের অস্তিত্ব ছিল এই যুগের মন্দিরগুলিতে। বাৎস্যায়ন লিখেছেন যে আদর্শ পত্নীর মধ্যে সেবা, সংযম, সাংসারিক দক্ষতার ইত্যাদি গুণ থাকা প্রয়োজন।
বিলাস ব্যাসন
বিত্তশালীরা বিলাস ব্যসনে দিন যাপন করত। তারা সুরম্য প্রাসাদে বাস করত। সমাজে মদের বাহুল্য প্রচলন ছিল। “কথাসরিৎ সাগর” গ্রন্থ থেকে জানা যায়। নারীরাও মদ্য সেবন করত।
দাস ব্যবস্থা
মনু বিভিন্ন শ্রেণীর দাসের উল্লেখ করেছেন। মনু যুদ্ধবন্দীদের স্থায়ী দাসত্বের কথা বলেছেন। দাসরা নানা রকম কাজ করত। একজন দাস ঠিক কি ধরণের কাজ করবে তা তার বুদ্ধিবৃত্তি ও মালিকের অবস্থার উপর নির্ভর করত। এই যুগে দাসীদের অনেক ক্ষেত্রে বারবনিতার জীবন ভোগ করতে হত। গুপ্তযুগের তীব্র বর্ণভেদ ব্যবস্থা এবং ব্রাহ্মণ প্রাধান্য দাস প্রথাকেও স্পর্শ করেছিল। ক্যাতায়ন স্মৃতিতে তার স্পষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়।
শিক্ষা ব্যবস্থা
গুপ্তযুগে শিক্ষা ব্যবস্থার যথেষ্ট উন্নতি ঘটেছিল। এইযুগে গুরুগৃহে শিক্ষা লাভে ছাত্রের প্রবেশাধিকার শুধুমাত্র তার মেধার উপর নির্ভর করত। মনু উপাধ্যায় ও আচার্য এই দুই শ্রেণীর শিক্ষকের কথা উল্লেখ করেছেন। সেই যুগের পাঠ্যসূচীর মধ্যে ছিল পুরান, বিধর্মীদের শাস্ত্র, অর্থনীতি, ন্যায় শাস্ত্র দন্ডনীতি চিকিৎসা শাস্ত্র গণিত, ব্যাকরণ ও বেদ। এই সময় আনুষ্ঠানিক শিক্ষায় ব্রাহ্মণ্য প্রতিষ্ঠান ও বৌদ্ধ বিহারগুলির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। বিহারগুলিতে ছাত্রাবস্থা ৩০-৩৭ বছর পর্যন্ত স্থায়ী হত। তবে ১০ বছর মেয়াদ ছিল সাধারণ ছাত্রদের ক্ষেত্রে। গুপ্তযুগে শিক্ষার জন্য প্রচুর আর্থিক অনুদানের ব্যবস্থা ছিল। এই সময় নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতি, সম্মান এশিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছিল। তবে শিক্ষা সর্বজনীন অধিকার স্বীকৃত ছিল না। এইভাবে গুপ্তযুগের সমাজ ব্যবস্থা উন্নত যুগ থেকে আদি মধ্যযুগীয় সমান্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় প্রবেশ করেছিল। ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেলেছিল মূল সংস্কৃতির ধারা।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .