ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লব শুরু হওয়ার কারণ
শিল্প বিপ্লবের সূচনা হয় ইংল্যান্ডে। এ সম্পর্কে পণ্ডিতরা নানা কারণের উল্লেখ করেছেন –
কৃষি বিপ্লব
অষ্টাদশ শতকে ইংল্যান্ডের জনসংখ্যা প্রবলভাবে বৃদ্ধি পায়। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে তাল রেখে খাদ্য ও কৃষিজাত পণ্যের উৎপাদনও বৃদ্ধি পায়। এক কথায়, এ সময় ইংল্যান্ডে কৃষিক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটে যায়। এর ফলে শিল্পের জন্য কাঁচামাল ও শ্রমিকদের জন্য সস্তায় খাদ্যের কোন অভাব হয় না। আর্থিক সচ্ছলতার ফলে কৃষকেরা শিল্পদ্রব্য ক্রয়ে সমর্থ হয়। এভাবে দেশের অভ্যন্তরে একটি বাজার গড়ে ওঠে।
কাঁচামাল, বাজার ও মূলধন
শিল্প বিপ্লবের জন্য তিনটি প্রয়ােজনীয় উপাদান হল— কামাল, প্রতিদ্বন্দ্বীহীন বিস্তৃত বাজার ও মূলধন। ইংল্যান্ডের ক্ষেত্রে এর কোনটিরও অভাব হয়নি। উত্তর আমেরিকা, আফ্রিকা ও এশিয়া মহাদেশের বিভিন্ন অঙুলে ইংল্যান্ডের উপনিবেশ স্থাপিত হয়। এইসব অঞ্চল থেকে ইংল্যান্ড অবাধে প্রচুর পরিমাণে কাঁচামাল সংগ্রহ করত এবং তার উৎপাদিত পণ্যাদিও সেখানে বিক্রি করত। এইসব স্থানে কার্যত একচেটিয়া বাণিজ্যের ফলে ইংরেজ বণিকরা প্রচুর মুনাফা অর্জন করে। তারা ভারত ও চীন থেকে নানা বিলাস দ্রব্য আমদানি করে ইওরােপের বাজারে বিক্রি করত এবং প্রচুর মুনাফা লুঠত। পলাশীর যুদ্ধের (১৭৫৭ খ্রিঃ) পর বাংলার ধনভাণ্ডার ইংরেজ কোম্পানীর হাতে আসে। এইসব কারণে ইংরেজ বণিকদের কখনই মুলধনের কথা চিন্তা করতে হয়নি।
সস্তা শ্রমিক
ষােড়শ শতক থেকে ইংল্যান্ডে কৃষিজমিকে পশুচারণ-ভূমিতে পরিণত করা শুরু হয়। এর ফলে সৃষ্টি হয় অসংখ্য ভূমিহীন বেকার কৃষক। তারা শহরের কলকারখানাগুলিতে নামমাত্র মজুরিতে শ্রমিক হিসেবে নিযুক্ত হতে থাকে। এছাড়া জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলেও শ্রমিকের যােগান সহজলভ্য হয়। এই সুলভ শ্রমিক শিল্প বিপ্লবের সহায়ক হয়।
সরকারি পৃষ্ঠপােষকতা
১৬৪০ খ্রিস্টাব্দে গৃহযুদ্ধের ফলে মধ্যবিত্তদের রাজনৈতিক শক্তি বৃদ্ধি পায়। তারা ইংল্যান্ডের অর্থনীতিতে নেতৃত্ব কায়েম করে এবং শিল্প বিপ্লবেও তাদের ভূমিকা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তারা পার্লামেন্টে সরকারকে শিল্পের উন্নয়নের জন্য সাহায্য করতে বাধ্য করে। ব্রিটিশ সরকারও দেশের ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের নানাভাবে সাহায্য করে। আমদানিকৃত বিদেশী পণ্যের ওপর উচ্চহারে শুল্ক বসিয়ে দেশীয় শিল্পকে সুরক্ষিত করে।
প্রাকৃতিক পরিবেশ
প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ ইংল্যান্ডে প্রচুর পরিমাণে কয়লা, লােহা, টিন ও তামা পাওয়া যেত। ইংল্যান্ডের স্যাতসেঁতে আবহাওয়া বস্ত্রশিল্পের। উপযােগী ছিল। প্রাকৃতিক বন্দর এবং দেশের অভ্যন্তরে প্রচুর খাল ও খাড়ি থাকায় কাঁচামাল ও পণ্য চলাচল অনেক সুবিধাজনক হয়
এই অনুকূল পরিবেশের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল বেশ কিছু যন্ত্রপাতির সময়ােপযােগী আবিষ্কার, যা শিল্প বিপ্লবকে ত্বরান্বিত করেছিল। ইংল্যান্ডে বস্ত্রশিল্পেই প্রথম যন্ত্রভিত্তিক উৎপাদন শুরু হয়। ১৭৩৩ খ্রিস্টাব্দে জন কে ‘উড়ন্ত মাকু’ বা ‘ফ্লাইং’ শাট’ নামে কাপড় বােনার এক উন্নত মানের যন্ত্র আবিষ্কার করেন। ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে হারগ্রিভস্ আবিষ্কার করেন সুতাে কাটার উন্নত যন্ত্র ‘স্পিনিং’ জেনি। আর্করাইট আবিষ্কার করেন। জলশক্তিচালিত কাপড় বােনার যন্ত্র ‘ওয়াটার ফ্রেম’ (১৭৬৯ খ্রিঃ)। কার্টরাইট আবিষ্কার করেন ‘মিউল’ (১৭৮৫ খ্রিঃ) নামে কাপড় বােনার এক উন্নত ধরনের যন্ত্র। এতদিন এই যন্ত্রগুলি জলশক্তি ও বায়ুশক্তির সাহায্যে চালানাে হত। ১৭৬৯ খ্রিস্টাব্দে জেমস্ ওয়াট বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কার করলে শিল্প উৎপাদনের ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটে গেল। বাষ্পীয় ইঞ্জিনের সাহায্যে যন্ত্রগুলিকে ইচ্ছেমতাে চালানাে যায় এবং বড় বড় কারখানা চালু করা সম্ভব হয়। ম্যাথু বােল্টন নামে এক ব্যক্তি জেমস্ ওয়াটের বাষ্পীয় ইঞ্জিন তৈরি করে বাজারে বিক্রি করতে থাকেন। এর নামে ‘বােল্টন ইঞ্জিন’। এর ফলে যন্ত্রগুলিকে ইচ্ছেমতাে চালিয়ে উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব হয়। ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দে জন স্মিটন কাঠকয়লার পরিবর্তে কয়লার সাহায্যে লােহা গলাবার চুল্লী বা ‘ব্লাস্ট ফার্নেস’ আবিষ্কার করেন। খনিগর্ভে নিরাপদে কাজ করার জন্য হামফ্রি ডেভি আবিষ্কার করেন ‘সেফটি ল্যাম্প’ (১৮১৫ খ্রিঃ)। পরিবহনের ক্ষেত্রেও যুগান্তর আসে। ১৮১১ খ্রিস্টাব্দে টেলফোর্ড ও মাকডােম পাথরকুচি ও পিচ দিয়ে মজবুত রাজপথ তৈরির কৌশল আবিষ্কার করেন। ১৮১৪ খ্রিস্টাব্দে জর্জ স্টিভেনসন্ বাষ্পচালিত রেলইঞ্জিন তৈরি করেন। ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে ফুলটন তৈরি করেন বাষ্পীয় পােত বা স্টিমার। এইসব আবিষ্কারকে কাজে লাগিয়ে ইংল্যান্ড প্রথম শিল্প বিপ্লবের পথে অগ্রসর হয়।
Comments ( 1 )
It’s very helpfull to me. Thanks for the information
You are welcome. We wish you all the best 🙂