জৈনধর্মের পটভূমি সহ মহাবীরের অবদান
জৈন সাহিত্যে ২৪ জন তীর্থঙ্করের উল্লেখ আছে। এদের মধ্যে প্রথম ২৩জন বুদ্ধের আগে আবির্ভাব ঘটেছিল। এদের অনেকেই হয়ত কাল্পনিক। তবে ২৩তম তীর্থঙ্কর পার্শ্বনাথ ছিলেন ঐতিহাসিক ব্যক্তি। তিনি বুদ্ধের জন্মের প্রায় ২০০ বছর আগে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। এর অনেক আগেই জৈনধর্ম ভারতে প্রচলিত ছিল। প্রথম জৈনগুরু ছিলেন আদিনাথ। তারপর অজিতনাথ, সম্ভবনাথ অভিনন্দননাথ, সুমতিনাথ, পদ্মপ্রভ, সুপার্শ্বনাথ, চন্দ্রপ্রভ, সুবিধিনাথ, শীতলনাথ, শ্রেয়াংশনাথ, বাসুপুজ্য, বিমলনাথ, অনন্তনাথ, ধর্মনাথ, শান্তিনাথ, কুনথুনাথ, অবনাথ, মল্লিনাথ, মুনিসুব্রত, নমিনাথ এবং নেমিনাথ পর্যায় ক্রমে তীর্থঙ্কর পদে ব্রতী হয়েছিলেন। প্রাগৈতিহাসিক সিন্ধু অববাহিকার বিভিন্ন স্থানে প্রাপ্ত সিলমোহরে কার্যোৎসর্গ ভঙ্গিতে বেশ কিছু অঙ্কিত মূর্তি পাওয়া গেছে। এইগুলি প্রথম তীর্থঙ্কর আদিনাথ বা ঋষভদেব-এর প্রতিকৃতি বলেই অনুমান করা হয়।
জয়ী কথার অর্থ হল “জিন”। আর “জিন” শব্দ থেকেই জৈন কথার উৎপত্তি। “জি” ধাতু থেকে জিন পদ নিস্পন্ন। অর্থাৎ যদি রাগ দ্বেষ, হিংসার রিপু জয় করেছেন—তিনি জিন বা আনন্দময় সিদ্ধপুরুষ।
জৈনদের বিশ্বাস পার্শ্বনাথের মৃত্যুর ২৫০ বছর পর ২৪তম বা সর্বশেষ তীর্থঙ্কর মহাবীরের জন্ম হয়। আসলে মহাবীরের জন্ম তারিখ সম্পর্কে দুটি মত আছে। একটি মতে তাঁর জন্ম ৫৯৯ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে, অন্যমতে ৫৩৯ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দে। কল্পসূত্র, ভগবতী সূত্র প্রভৃতি জৈন গ্রন্থে মহাবীরের জীবনী বর্ণিত আছে। বৈশালীর উপকণ্ঠে কুন্ডুগ্রাম এক অভিজাত জ্ঞাতৃ পরিবারের কন্যা ত্রিশলা। জৈনগ্রন্থাদিতে ব্রাহ্মণ ঋষভের পত্নী দেবনন্দাকেও মহাবীরের মা বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
মহাবীরের আসল নাম বর্ধমান। নাত বা জ্ঞাতৃ বংশে জন্ম বলে তাঁর আর এক নাম নাতপুত্র বা জ্ঞাতৃপুত্র । গোত্রের নাম থেকে তাকে কাসবও বলা হয়। বৈশলীতে জন্মেছিলেন বলে তিনি বেসলিয় বা বৈশালীয়। বিদেহে তার জন্ম, তাই তিনি বেদেহদিন্ন নামেও পরিচিত ছিলেন।
যথা সময় যশোদার সঙ্গে মহাবীরের বিবাহ হয়। তাঁর একটি কন্যা হয়, নাম অনজ্জা বা প্রিয়দর্শনা। মহাবীর যে বিবাহ করেছিলেন, সে কথা দিগম্বর সম্প্রদায়ের জৈন্যরা স্বীকার করেন না। তাঁরা মনে করেন, মহাবীর আজন্ম ব্রহ্মচার্য পালন করেছিলেন।
গৃহত্যাগ করলে পিতা মাতা মনে আঘাত পাবেন বলে মহাবীর তাদের জীবনদশায় সংসার ধর্ম পালন করেন। কিন্তু তাঁরা মারা গেলে আর সে বাধা থাকল না অগ্রজ নন্দীবর্ধনের অনুমতি নিয়ে শীতের প্রারম্ভে তিনি গৃহত্যাগ করেন। পিতা-মাতার মৃত্যুর পর মহাবীর গৃহত্যাগ করেন, এ মত শ্বেতাম্বর সম্প্রদায়ের। দিগম্বর সম্প্রদায়ের অভিমত পিতা মাতার জীবিত কালেই মহাবীর গৃহত্যাগ করেছিলেন। গৃহত্যাগের সময় তার বয়স ছিল ৩০ বছর। এর ১৩ মাস পরে এক শীতকালে তিনি তাঁর একমাত্র পরিধেয় বস্ত্র খানিও পরিত্যাগ করেন। এরপর শুরু হয় তার “দিগম্বর” পরিব্রাজকের জীবন। ১২ বছর কঠোর সাধনার পর তিনি কেবল জ্ঞান লাভ করেন।
বুদ্ধদেব এক নতুন ধর্ম প্রবর্তন করেছিলেন কিন্তু মহাবীর ২৩জন তীর্থঙ্কর যে ধর্ম প্রচার করেছিলেন তারই প্রসার ঘটিয়েছিলেন। তাঁর পূর্বগামীরা চতুর্যামের কথা বলেছিলেন। কিন্তু মহাবীর একটি “নতুন বিধান” যুক্ত করেছিলেন প্রচলতি জৈনধর্মের সঙ্গে। এই পাঁচটি বিধানকে একত্রে পঞ্চমহাব্রত বলা হয়। এই গুলি হল অহিংসা, সুনৃত, অস্তেয়, অপরিগ্রহ এবং ব্রহ্মচর্য।
ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে মহাবীর পূর্ব ভারতের নানা স্থানে ভ্রমণ করেন। বছরের ৮ মাস তিনি ভ্রমণ করতেন এবং বর্ষার ৪ মাস কোন শহরে অবস্থান করতেন। চম্পা, বৈশালী, রাজগৃহ, মিথিলা, শ্রাবন্তী ও পাবাপুরীতে তাঁর প্রিয় স্থান ছিল। প্রসঙ্গত স্মরণীয়, তিনি পশ্চিমবঙ্গের বাকুড়া, পুরুলিয়া, অঞ্চলও পরিভ্রমণ করেছিলেন।
সমাজের নানা শ্রেণীর মানুষ তার ধর্মমত গ্রহণ করেছিল। তাঁর প্রথম শিষ্য ছিলেন মংখলিপুত্ত গোসাল। মগধরাজ বিম্বিসার এবং অজাতশত্রু তাঁর অনুগামী ছিলেন। মহাবীরের শিষ্যদের মধ্যে ইন্দ্রভূতি সকলের শ্রেষ্ঠ ছিলেন এবং মহিলা শিষ্যা ছিলেন চন্দনা। দীর্ঘ ৪২ বছর ধরে মহাবীর পূর্ব ভারতের নানা স্থানে জৈনধর্ম প্রচার করেন। অবশেষে ৭২ বছর বয়সে পাটনার নিকট পাবাপুরী নগরে তিনি দেহত্যাগ করেন।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .