বৈদিক যুগ থেকে গুপ্ত যুগ পর্যন্ত ভারতের নারীদের অবস্থা
ঋগ্বেদ হল বৈদিক সাহিত্যের প্রথম গ্রন্থ। এই গ্রন্থে সরাসরি নারীর স্থান সম্বন্ধে বিশেষ কোন কথা নেই তবে নানা বর্ণনা ও উপমা থেকে নারীর স্থান সম্বন্ধে ধারণা করা যায়। বেদের প্রথম স্তরের মন্ত্রগুলিতে নারী অপেক্ষাকৃত স্বাধীনচারিণী। এই যুগের নারী নিজেই তার জীবনসঙ্গী বেছে নিত। যাকে বলা হয় অবৈধ প্রণয় তা নিয়ে ঋগ্বেদের ঋষিদের কোন কুণ্ঠা নেই। বরং অবৈধ প্রণয় একটি সর্বজনস্বীকৃত একটি সামাজিক প্রথা। নারীর ইচ্ছাক্রমে নারীহরণের কথাও ঋগ্বেদে উল্লেখ আছে। পুরুমিত্রের কন্যাকে বিমদ হরণ করছেন-এমন প্রমাণ আছে।
বিবাহের কন্যাপণের কথা পাওয়া যায়। পুরুষের বহু পত্নীত্বের কথা পাওয়া যায়। কন্যার শরীরে ত্রুটি থাকলে বরপণের কথা আছে একাধিকবার। কুমারী কন্যার কথাও বেশ কয়েরবার আছে। এদের বলা হত অমাজু অর্থাৎ যারা বাপের বাড়িতেই বুড়ো হয়ে যায়। এই বেদে সহমরণের উল্লেখ নেই।
ইতিহাসের উপাদান থেকে জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মের উত্থান সম্পত্তি হিসাবে স্ত্রীর স্থান গরুর নিচে কারণ নতুন গরু কিনতে টাকা লাগে-আর নতুন বৌ আনলে টাকা পাওয়া যায়। উত্তর বৈদিক যুগে নারীর বহু বিবাহের কথাও শোনা যায়। অর্থববেদ থেকে জানা যায় সে নারীর পূর্বে একজন পতি ছিল সে যখন পুরুষকে লাভ করে তখন পঞ্চৌদন অজ দান করলে তার কোন ক্ষতি হয় না। যজ্ঞে যজমানের পত্নী পাশে থাকেন কিন্তু নিষ্ক্রিয় ভাবে। তার উপনয়ন নেই অতএব “ন স্ত্রী জুহুযাৎ নারী” হোম করতে পারবে না। গৃহকর্ম ভিন্ন কোন বৃত্তি কুলনারীর ছিল না। মেয়েদের শিক্ষার ক্ষেত্রে বেদ অধ্যয়নের প্রবেশদ্বার নারীদের ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ ছিল। বেদের যুগে কিছু কিছু নারী শিক্ষা লাভের সুযোগ পেতেন যেমন বিশ্ববারা, মোষা, অপালা ও গোধা। কিন্তু ধীরে ধীরে গণিকা ছাড়া শিক্ষাতে আর কোন নারীর অধিকার ছিল না। অনুমান করা হয় যে সঙ্গীত, নৃত্য ও চিত্রশিল্পে কিছু কিছু কুমারীর অধিকার ছিল কিন্তু অন্যান্য বিদ্যা থেকে সাধারণভাবে নারীরা বঞ্চিত ছিল।
নারীর স্থান ক্রমেই অন্তঃপুরের গহনে সরে গেছে। যদিও ঋগ্বেদে যোদ্ধা নারী মুদগলিনী, বিশপলা, বধ্রিমতী, শশীয়সীর নাম জানা গেলেও পরবর্তী যুগে প্রকাশে সমাজ জীবনে নারীর কোন ভূমিকা ছিল না। স্ত্রীর প্রধান প্রয়োজন হল সে সন্তানের জননী এবং তার প্রধান কর্তব্য হল পুত্রসন্তানের জন্ম দেওয়া। নিঃসন্তান বধূকে বিবাহের ১০ বছর পরে, শুধু কন্যা সন্তানের জন্ম দেওয়ার জন্য বিবাহের ১২ বছর পরে, মৃতবৎসাকে বিবাহের ১৫ বছর পর ত্যাগ করা যেত। তবে ভ্রষ্টা স্ত্রীকে প্রায়শ্চিত্তে দ্বারা শুচি হওয়ার একটা সুযোগও দেওয়া হয়েছিল। অর্থাৎ নারীর কৌমারে রক্ষা করবেন পিতা, যৌবনে স্বামী, বার্ধক্যে পুত্ররা-নারীর স্বাধীনতার যোগ্য নয়। স্বামী কর্তৃক বধূকে অসম্মান করলে নিস্প্রতিবাদে তাকে তা সহ্য করতে হবে অথচ তার সামান্যতম পদস্খলনে সমাজ কঠোরভাবে দন্ড দিত।
মহাকাব্যের যুগে পতি দেবতা, পতি নারীর একমাত্র গতি, পতির স্ত্রীকে সন্দেহ করবার অবাধ অধিকার এবং সে সন্দেহ বশে স্ত্রীকে ত্যাগ করবার অধিকার জনসাধারণের নারী চরিত্রে সন্দেহ করবার এবং সে সন্দেহকে নিরপরাধ নারীকে দণ্ড দেবার অধিকার এ সবই এসেছে অতিপৌরাণিক যুগের সামাজিক মূল্যবোধ এবং নারীর স্থান নিরুপণের এক তরফা অধিকার থেকে। নারীর অবস্থার এই অবণমন রামায়ণে অত্যন্ত স্পষ্ট। মহাভারতে এ চিত্র আর প্রত্যক্ষ। ব্যাপক ও সন্দেহ বাচক। তবে মহাভারতের নারী সোমপান করেন। প্রকাশ্য চলাফেরা করেন এবং নিজেদের সম্পর্কে বহু সিদ্ধান্ত নিজেরাই গ্রহণ করতেন। যেমন দ্রৌপদী বিবাহের সময়ে বাদ প্রতিবাদ করেছিলেন। জটিল্য এবং বাক্ষীও বহু পতিকা ছিল। নারী নিজের ইচ্ছামত কুমারী থেকে তপস্যা করতে পারত তার দৃষ্টান্তও আছে। অন্যদিকে শান্তিপর্বে ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরকে বলেছেন নারীর চেয়ে অশুভতর আর কিছুই নেই।
বৎস, নারীর প্রতি পুরুষের কোন স্নেহ মমতা থাকা উচিত নয়। পূর্বজন্মের পাপের ফলে এ জন্মে নারী হয়ে আসতে হয়। নারী সর্পের মত পুরুষের তাকে কখনই বিশ্বাস কার উচিত নয়। আবার বহুস্থানে সতী ও কর্তব্যপরায়ণা নারীর প্রশংসাও আছে।
ধর্মের প্রসঙ্গে নারী অবস্থান যথেষ্ট নিচুতেই ছিল। মন্ত্রোচ্চারণের সঙ্গে পিন্ডদানের অধিকার ছিল না তাদের। তিনবর্ণের পুরুষই বৈদিক বিধি অনুসারে স্মাণ করতে পারত কিন্তু নারীর সে অধিকার ছিল না।
স্মৃতি ও পুরাণের যুগে নারী শিক্ষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে কোন সম্পর্ক ছিল না। শতপথ ব্রাহ্মণে বলা হয়েছে প্রব্রজ্যা শিক্ষা দেওয়ার সময় শিক্ষক নারী, শূদ্র, সারমেয় ও কৃষ্ণবর্ণ পক্ষী দেখতে নিষেধ করতেন—কেননা তারা অসত্য। পারস্কর গৃহসূত্রে বলা হয়েছে সমাবর্তন উৎসবের শেষে নারী দর্শন ও বাক্য বিনিময় ও নিষিদ্ধ। বৌধায়ন ধর্মসূত্রে বলা হয়েছে।
সাফল্য অর্জনের জন্য ব্রত পালন করছে এমন ব্রহ্মচারীর নারীর সঙ্গে কথা বলা উচিত নয়। মনুও চান্দ্রায়ন ব্রত পালনের সময় নারীর সঙ্গে কথা বলা নিষেধ করেছেন। সাংখ্যায়ণ গৃহয়সূত্র অনুসারে ঋতুমতি নারীর উপস্থিতিতে বেদপাঠ কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ ছিল। বৃহৎ সংহিতায় বলা হয়েছে সূর্য ও চন্দ্রের ১/৬ শতাংশ যে গ্রহণ লাগে তাতে নারী বিলাপ হয়। অর্থাৎ তৎকালীন সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ হওয়া সত্ত্বেও নারীকে যে অবহেলিত অবস্থায় রাখা হয়েছিল তা আজকের গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দুঃখজনক বলে মনে হয়। কিন্তু প্রাচীন পিতৃতান্ত্রিক শ্রেণীবিভক্ত সমাজে যেখানে নারীর ওপর পুরুষের আধিপত্য ছিল সেখানে এরকম অবস্থা সাধারণত পরিলক্ষিত হয়।
গুপ্তযুগের প্রান্ত লগ্নে বিভিন্ন সাহিত্য থেকে জানা যায় যে নারী স্বামী ব্যতীত কোন পুংলিঙ্গন্তে (নামের বস্তু) চন্দ্র; সূর্য, বৃক্ষ ও দর্শন করে না সেই ধর্মচারিনী। অর্থাৎ ধর্মচারিনী নারী সকল সময়ই অবগুণ্ঠিত থাকবে। এ অবরোধ ব্যবস্থা পর্দাপ্রথার এক চূড়ান্ত রূপ। এই সময় থেকেই ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে নারী তার সব স্বাধীনতা হারায়। রাজতন্তপুরে দাসীও রাজপুরুষের ভোগ্যবস্তু ছিল। শ্রমের সঙ্গে দেহও দান করতে হত সর্বদা নারীকে। পুরাণে নারীর যে চূড়ান্ত অবমাননা নির্লজ্জ অসংকোচে অসংখ্যবার উচ্চারিত হয়েছে।
পরিশেষে ঐতিহ্যবাহী সাহিত্যে ভারতীয় নারীকে কিরূপে চিত্রিত করেছে তা দিয়েই শেষ করব। কালিদাসের অভিজ্ঞন শকুন্তলমে নায়িকা শকুন্তলা নিজেকে কলঙ্কমুক্ত করার প্রয়োজনবোধটি সুন্দর ভাবে চিত্রিত করেছেন। আবার মেঘদূতে চিত্রিত করেছেন পুরুষের ক্ষেত্রে নারীও সাধণার ধর্ম তাকেও পেতে হয় দুঃখের মূল্যে। “রঘুবংশে” পুরুষের বহু পত্নীত্ব উপমা বারবার উল্লেখিত। সীতার চরিত্রচিত্রণে কালিদাসের মূল লক্ষ্যই ছিল বাল্মীকির মূল্যবোধের সমালোচনা করা। যেমন অযোধ্যায় সীতা বিসর্জনের ব্যাপারে বাল্মীকির রাম দুঃখিত অন্যদিকে কালিদাসের রামের নৈতিক বোধ দ্বিধাগ্রস্ত। অমরুশতকে নারী প্রেমিকারূপে নানাভাবে চিত্রিত। ষষ্ঠ শতক থেকে ২/৩টি ব্যতিক্রম বাদে সাহিত্যে নারীর চিত্র হল—“ভোগ্যবস্তু”। ভারবির “কিরাতাজনীয়”র অপ্সরাদের চিত্রিত করা হয়েছে গণিকা বা বৈশ্যা রূপেই। সপ্তম শতকে বাণভট্টের “কাদম্বরী” নায়িকারাও এই ছকে নির্মিত হয়েছিল। এই শতকেরই শেষদিকে রচিত রাজা শ্রী হর্ষের তিনটি নাটক রত্নাবলী, প্রিয়দর্শিকা, নাগানন্দ নারী চরিত্র হল নায়িকা, দূতী, গণিকা সখী, সপত্নী—কিন্তু নারী চরিত্রই যান্ত্রিক ও বৈশিষ্ট্যবর্জিতা। নারী নরকের দ্বার প্রলোভন ও পতনের হেতু–এই কথাই যেন বারবার চিত্রিত হয়েছে।
শূদ্রকের মৃচ্ছকটিকে নারী কুলবধু ও গণিকা এই দুই ভূমিকাতেই আছে। নারী চরিত্র চিত্রণে বোধ হয় ভবভূতিৰ বৈশিষ্ট্যই সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। মালতীমাধব নাটকে মালতী চরিত্রে প্রথম নালিশ করার ভাষা পেল সাহিত্যে।
কল্হনের রাতরঙ্গিনীতে ভাল মন্দ দুই রূপই চিত্রিত। সেখানে নারীর নানা পরিচয় : রাজ্ঞী, উপপত্নী, গণিকা, কুট্টনী, দেবদাসী, রক্ষিতা, কূলবধূ ও মাতা। দেবদাসী এবং নারীক্রয়ের তথ্য পাওয়া যায় তার রচনায়। সহমরণে সতী হওয়ার বিবরণ দিয়েছেন। পতিই নারী দেবতা এবং নারীর সতীত্ব রক্ষা একটি পবিত্র ব্যাপার এর উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। এক কথায় কলহন ধর্মশাস্ত্র ও স্মৃতির যুগের মূল্যবোধকেই সমর্থন করেছেন। অর্থাৎ প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যে নারীকে প্রেমের বাতাবরণ ছাড়া অন্য কোন ভাবে দেখা হয় নাই।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .