তৃতীয় ইঙ্গ মারাঠা যুদ্ধ
দ্বিতীয় ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধে পরাজয় ও অপমানকর সন্ধি স্বাক্ষরের জ্বালা কোনাে মারাঠা নেতা ভুলতে পারেননি। পেশােয়াসহ মারাঠা সর্দারেরা ক্রমে বুঝতে পরেন যে , অধীনতামূলক মিত্রতা নীতি ভিত্তিক সন্ধি স্বাক্ষর করার ফলে স্বাধীন মারাঠা রাজ্যের অস্তিত্ব নষ্ট হয়েছে। অতঃপর কালক্রমে ইংরেজ শক্তি সর্বময় হয়ে উঠবে। তাই যে কোনাে শর্তে ইংরেজদের আঘাত হানার ইচ্ছা মারাঠা নেতৃবৃন্দের মনে দানা বাঁধছিল । পেশােয়া আন্তরিকভাবে ‘ বেসিনের সন্ধি ’ ( ১৮০২ খ্রিঃ ) মেনে নিতে পারেন নি। তাই তিনিও ইংরেজ প্রভাব মুক্ত হতে আগ্রহী ছিলেন । অন্যান্য মারাঠা সর্দারেরা এই মুহূর্তে পেশােয়ার পাশে দাঁড়াতে পিছপা ছিলেন না । তবে পুনা দরবারের ব্রিটিশ রেসিডেন্ট এলফিনস্টোন মারাঠা সর্দারদের গতিবিধির উপর তীক্ষ্ণ নজর রাখছিলেন। তাই মারাঠা নেতারা বাইরে ইংরেজ বন্ধুত্ব বজায় রেখে নিজেদের সংহত ও শক্তিশালী করছিলেন।
ইঙ্গ মারাঠা বিরোধ
বরােদা সংক্রান্ত একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে ইঙ্গ মারাঠা বিরােধ প্রকাশ হয়ে পড়ে । বরােদার গাইকোয়াড় ছিলেন পেশােয়ার সামন্ত । পেশােয়াকে প্রদেয় গাইকোয়াড় -এর কর অধিক দিন বাকি পড়ায় উভয়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দেয় । এই বিরােধ মীমাংসার জন্য ইংরেজ কর্তৃপক্ষ মধ্যস্থতা শুরু করে । সেই মতাে গাইকোয়াড় -এর মন্ত্রী গঙ্গাধর শাস্ত্রী ইংরেজ প্রহরাধীনে পেশােয়ার দরবারে উপস্থিত হন । এদিকে গাইকোয়াড় এবং গঙ্গাধর শাস্ত্রী উভয়েই ছিলেন ব্রিটিশ তাবেদার । তাই এদের প্রতি অন্যান্য মারাঠাদের ক্ষোভ ছিল । পেশােয়ার মন্ত্রী ত্রিম্বকজী ডিংলে ছিলেন বিচক্ষণ , দেশপ্রেমিক এবং ইংরেজ বিদ্বেষী । ইংরেজের প্রাধান্যের বিরুদ্ধে মারাঠাদের ঐক্যবদ্ধ করার পেছনে তার বিশেষ অবদান ছিল । যাই হােক , গঙ্গাধর শাস্ত্রী পুনায় আসার পর আততায়ীর হাতে নিহত হন ( ১৮১৫ খ্রিঃ ) । ইংরেজগণ এই হত্যাকাণ্ডের জন্য ত্রিম্বকজীকে দায়ী করে এবং পুনায় তাকে বন্দি করে রাখা হয় । কিন্তু এক বছরের মধ্যেই ত্রিম্বকজী বন্দিদশা মুক্ত হয়ে আত্মগােপন করেন । ইংরেজ কর্তৃপক্ষ এজন্য পেশােয়াকে দায়ী করে এবং ত্রিম্বকজীকে ধরে দেবার জন্য পেশােয়ার উপর চাপ দিতে থাকে । অবশ্য পেশােয়া ইংরেজের দাবিকে নস্যাৎ করে দেন ।
পুনা সন্ধি
এদিকে গভর্নর জেনারেল লর্ড হেস্টিংস পিণ্ডারি দস্যুদের দমনের জন্য এক পরিকল্পনা করছিলেন । পিণ্ডারিদের সাথে মারাঠাদের বন্ধুত্ব ছিল । তাই ইঙ্গ-পিণ্ডারী যুদ্ধে মারাঠাদের পিণ্ডারিদের পক্ষে যােগদানের সমূহ সম্ভাবনা ছিল । তা যাতে সম্ভব না হয় সেজন্য লর্ড হেস্টিংস পেশােয়ার উপর জোরপূর্বক ‘ পুনা সন্ধি ’ ( ১৮১৭ খ্রিঃ ) চাপিয়ে দেন । এই সন্ধি অনুসারে পেশােয়া পদ লুপ্ত হয় । পেশােয়া তার রাজ্যের একাংশ ইংরেজের হাতে সমর্পণ করেন ।
নাগপুর সন্ধি
এই সময়ে নাগপুর রাজ্যে অভ্যন্তরীণ গােলযােগ চলছিল । রঘুজী ভোঁসলের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র পার্শ্বজী ভোঁসলে নাগপুরের সিংহাসনে বসেন । কিন্তু তার আত্মীয় আপ্পা সাহেব ক্ষমতালাভের আশায় ইংরেজের সাথে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন এবং ‘ নাগপুরের সন্ধি ’ দ্বারা অধীনতামূলক মিত্রতায় আবদ্ধ হন ।
তৃতীয় ইঙ্গ মারাঠা যুদ্ধ
‘পুনা সন্ধি’ ও ‘নাগপুরের সন্ধি’ মারাঠা সর্দারদের প্রচণ্ডভাবে ক্ষুব্ধ করে । পেশােয়ার নির্দেশে পুনার ইংরেজ রেসিডেন্সি অগ্নিদগ্ধ করা হয় । শুরু হয় ‘ তৃতীয় ঈঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধ ’ । প্রাণপণ যুদ্ধ করেও মারাঠা বাহিনী পরাজিত হতে থাকে । কিরকীর যুদ্ধে পেশােয়া পরাজিত হন । ভোঁসলে এবং হােলকার বাহিনীও বিধ্বস্ত হয় । অতি ও কোরগাঁও -এর যুদ্ধে চূড়ান্তভাবে পরাজিত হয়ে পেশােয়া আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হন ( ১৮১৯ খ্রিঃ ) ।
তৃতীয় ইঙ্গ মারাঠা যুদ্ধের গুরুত্ব ও ফলাফল
মারাঠা শক্তির চূড়ান্ত পতন ডেকে এনেছিল তৃতীয় ঈঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধ । অতঃপর পেশােয়াপদ স্থায়ীভাবে লােপ করা হয় । পেশােয়ার রাজ্য কোম্পানির অন্তর্ভুক্ত হয় । পেশােয়াকে বাৎসরিক ৮ লক্ষ টাকা ভাতাদানের ব্যবস্থা করা হয় । তা ছাড়া হােলকার অধীনতামূলক মিত্রতার অন্তর্ভুক্ত হন । আপ্পা সাহেবকে নাগপুর থেকে বিতাড়িত করা হয় । নাগপুরের একাংশ ইংরেজের হস্তগত হয় । বাকি অংশ কোম্পানির এক অনুগত ব্যক্তিকে বসানাে হয় । পেশােয়ার রাজ্যের একটি শিবাজীর জনৈক বংশধরকে দান করা হয় ।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .