সমুদ্রগুপ্তের রাজ্যজয় ও তার কৃতিত্ব
সমুদ্রগুপ্ত
সমুদ্রগুপ্তের এলাহাবাদ প্রশস্তি নামক স্তম্ভলিপি থেকে জানা যায় যে রাজা প্রথম চন্দ্রগুপ্ত তাঁর জীবনকালেই তাঁর পুত্র সমুদ্রগুপ্তকে উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন। আনুমানিক ৩৩০ খ্রীষ্টাব্দে থেকে ৩৩৫ খ্রীষ্টাব্দে সিংহাসন আরোহণ করেন। ৩৮০ খ্রীষ্টাব্দে রাজত্ব করেন। অনুমান করার কারণ আছে যে সমুদ্রগুপ্তের এই মনোনয়ন অনেকের মনঃপুত হয়নি, এবং সিংহাসনে আরোহণ করার পর সমুদ্রগুপ্তকে একটি বিদ্রোহের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য যে ‘কাচ’ নামক এক ব্যক্তির কিছু মুদ্রা পাওয়া গেছে যেগুলি সমুদ্রগুপ্তের মুদ্রার অনুরূপ। তাই কেউ কেউ বলেন যে “কাচ” ছিলেন সমুদ্রগুপ্তের বড় ভাই, যাঁকে পরাস্ত করে সমুদ্রগুপ্ত সিংহাসন সুদৃঢ় করেন। আবার কেউ কেউ বলেন কাচ সমুদ্রগুপ্তের অপর এক নাম।
উত্তর ভারত বিজয়
সিংহাসন লাভ করার পর সমুদ্রগুপ্ত রাজ্যবিস্তারে মন দেন। তাঁর দিগ্বিজয়ের কাহিনী হরিষেণ রচিত সমুদ্রগুপ্তের “এলাহাবাদ প্রশস্তিতে” বর্তমান। উত্তর ভারতের নয় জন রাজাকে তিনি পরাস্ত করেন এবং তাঁদের রাজ্য নিজ এলাকাভুক্ত করেন। এই নয় জন রাজাদের মধ্যে দুজন ছিলেন নাগবংশীয়, নাগসেন ও গণপতিনাগ। আমরা আগেই দেখেছি যে নাগবংশীয়রা বিদিশা, কান্তিপুর, মথুরা ও পদ্মাবতীতে রাজত্ব স্থাপন করেছিলেন। এই উভয় নাগবংশীয় রাজা ঠিক কোন জায়গায় রাজত্ব করতেন তা বলা শক্ত। অপর দুজন রাজা, অচ্যুত ও চন্দ্রবর্মা, যথাক্রমে অহিচ্ছত্র ও পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া অঞ্চলে রাজত্ব করতেন। বাকি পাঁচজন ছিলেন রুদ্রদেব, মাতিল, নাগদত্ত, নন্দী ও বলবর্মা। এঁদের এলাকাগুলি কোথায় ছিল বলা যায় না।
করদরাজ্য
উত্তর ভারতের উপরিউক্ত নয়জন রাজার রাজ্যের অবস্থান সঠিক ভাবে জানা না গেলেও, সমুদ্রগুপ্তের এলাহাবাদ প্রশস্তিতে যে প্রত্যন্ত রাজ্যগুলির কথা আছে, যাদের রাজারা সমুদ্রগুপ্তের আনুষ্ঠানিক অধীনতা স্বীকার করতেন, সেগুলি থেকে উত্তর ভারতে তাঁর অধিকৃত এলাকাগুলি সম্পর্কে একটা সুস্পষ্ট ধারণা করা সম্ভব। এই পাঁচটি প্রত্যন্ত করদ রাজ্য ছিল সমতট, কামরূপ, নেপাল, ভাবক এবং কর্তৃপুর। সমতট হচ্ছে দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গদেশ, কামরূপ হল উত্তর আসাম ও বর্তমান নেপালের ডাবক অঞ্চল এবং আসামের নওগাঁ অঞ্চল, আর কর্তৃপুর ছিল পাঞ্জাবের জালন্ধর জেলার বর্তমান কর্তারপুর অঞ্চল।
ট্রাইবরাজ্য
আর্যাবর্তের নয়জন রাজা ও পাঁচটি প্রত্যন্ত রাজ্য ছাড়াও বহু ট্রাইব, অগ্রসর ও অনগ্রসর, রাজ্যের রাজারা সমুদ্রগুপ্তের বশ্যতা স্বীকার করেছিল। এই রকম ট্রাইবের সংখ্যা নয়টি। ১) মালব, যারা বাস করত পূর্ব রাজস্থানে, বিশেষ করে মেবার, টংক ও কোটা অঞ্চলে । ২) আর্জুনায়ন, যারা বাস করত বর্তমান জয়পুর ও তার চার পাশের অঞ্চলে। ৩) যৌধেয়, যারা বাস করত শতদ্রু নদীর দুই কুলে এবং যাদের এলাকা ভরতপুর সহ যমুনার তীর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। ৪) মদ্রক, যারা বাস করত ইরাবতী ও চন্দ্রভাগা নদীদ্বয়ের মধ্যবর্তী অঞ্চলে এবং যাদের রাজধানী ছিল শাকল বা শিয়ালকোট। ৫) ‘সনকানিক’, যারা বাস করত ভীলসার নিকটবর্তী অঞ্চলে। ৬) আভীর, যারা বাস করত ভীলসা ও ঝাঁসির মধ্যবর্তী এলাকায়। ৭) প্রার্জুন। ৮) কাক এবং ৯) খরপরিক, যাদের সঠিক অবস্থান নির্ণয় করা না গেলেও তারা যে বর্তমান মধ্যপ্রদেশ অঞ্চলের বাসিন্দা ছিল এটা সুনিশ্চিত।
দক্ষিণ ভারত অভিযান
সমুদ্রগুপ্ত দক্ষিণ ভারতেও অভিযান করেছিলেন এবং বারোজন রাজ্যকে পরাস্ত করেছিলেন বলে এলাহাবাদ-প্রশস্তিতে দাবি করা হয়েছে। অবশ্য তিনি দক্ষিণ ভারতের কোন স্থান নিজ সাম্রাজ্যের অঙ্গীভূত করেননি, শুধু রাজাদের বশ্যতা আদায় করেই সন্তুষ্ট ছিলেন। যে বারোজন রাজা তাঁর হাতে পরাজিত হয়েছিলেন তাঁরা হচ্ছেন ১) কোলদের মহেন্দ্র, এই অঞ্চলটি হল কোশল, দ্রুগ, রায়পুর, বিলাসপুর ও সম্বলপুর জেলাগুলি নিয়ে গঠিত ছিল, ২) মহাকান্তারের ব্যাঘ্ররাজ, মহাকান্তার বলতে বোঝাত উড়িষ্যার জয়পুরের অরণ্যাকীর্ণ অঞ্চল, ৩) পিষ্টপুরের মহেন্দ্রগিরি, পিষ্টপুর বর্তমান গোদাবরী জেলার পিঠপুরম, ৪) বেঙ্গির হস্তিবর্মা, বেঙ্গি ছিল বর্তমান পেড্ড বেগি, এল্লোরের সাত মাইল উত্তরে কৃষ্ণা ও গোদাবরী মধ্য অঞ্চলে, হস্তিবর্মা ছিলেন শালংকায়ন রাজা, ৫) পালক্কের উগ্রসেন, পালক্ক ছিল বর্তমান নেল্লোর জেলা, ৬) কাঞ্চীর বিষ্ণুগোপ, কাঞ্চী চিঙ্গলেপুত জেলার কঞ্জীবরম, বিষ্ণুগোপ ছিলেন পল্লববংশীয় রাজা, ৭) এরন্ডপল্পের দমন, (৮) দেবরাষ্ট্রের কুবের, ৯) কৌরালের মন্তরাজ, ১০) কোট্রুরের স্বামীদত্ত, ১১) অবমুক্তোর নীলরাজ এবং ১২) কুস্থলাপুরের ধনঞ্জয় উল্লিখিত তালিকার সপ্তম থেকে দ্বাদশ সংখ্যক স্থানগুলিকে সঠিকভাবে নির্দিষ্ট করা সম্ভবপর হয়নি।
বৈদেশিক সম্পর্ক
প্রত্যন্ত রাজ্যগুলি এবং দক্ষিণ ভারতের বিজিত রাজ্যগুলিকে সমুদ্রগুপ্ত নিজ রাজত্বের এলাকাভুক্ত করেননি, ওই সকল স্থানের রাজাদের আনুষ্ঠানিক বশ্যতা গ্রহণ করেই তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন। পশ্চিম ভারতের শক ক্ষত্রপেরা তাঁর প্রাধান্য স্বীকার করে নিয়েছিলেন। পশ্চিম পাঞ্জাব ও আফগানিস্তানের কুষাণ রাজ্য, যাঁর উপাধি ছিল দৈবপুত্র-শাহি-শাহানুশাহী, তাঁর সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন। কুষাণদের কিছু মুদ্রায় সমুদ্র ও চন্দ্রের নাম উল্লিখিত হয়েছে। গুপ্তদের কিছু মুদ্রা পশ্চিমের শক শাসকেরা চালু করেছিলেন যা প্রমাণ করে যে ওই সকল অঞ্চলে সমুদ্রগুপ্তের প্রাধান্য স্বীকৃত ছিল।
একটি চৈনিক পুঁথি থেকে জানা যায় যে সিংহলের রাজা মেঘবর্ণ (৩৫২-৭৯ খ্রীঃ) বৌদ্ধ গয়াতে সিংহলী ভিক্ষুদের জন্য একটি সংঘারাম প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন এবং সেই উদ্দেশ্যে সমুদ্রগুপ্তের কাছ থেকে অনুমতি চেয়েছিলেন যা সমুদ্রগুপ্ত মঞ্জুর করেছিলেন। এই সংঘারামটি পরে খুব বৃহৎ হয়েছিল যা হিউয়েন সাঙের বর্ণন থেকে জানা যায়।
ব্যক্তিগত গুণাবলী ও কৃতিত্ব
সমুদ্রগুপ্ত যে খুব বড় যোদ্ধা ছিলেন তাতে কোন সন্দেহ নেই, এবং অশোকের পর তিনিই একমাত্র সম্রাট যিনি প্রায় গোটা ভারতবর্ষের আনুগত্য আদায় করেছিলেন। এলাহাবাদ প্রশস্তিতে তাঁকে কবি ও সঙ্গীতজ্ঞ বলে অভিহিত করা হয়েছে এবং তাঁর মুদ্রায় তাঁর বীণাবাদনরত মূর্তি দেখে ওই দাবিকে সত্য বলেই মনে হয়। সমুদ্রগুপ্ত ব্রাহ্মণ্য ধর্মের অনুরাগী ছিলেন। তিনি অশ্বমেধ যজ্ঞ করেছিলেন এবং সেই উপলক্ষে বিশেষ এক ধরণের মুদ্রারও প্রচলন করেছিলেন। সমুদ্রগুপ্ত দীর্ঘকাল রাজত্ব করেছিলেন। তিনি ৩৮০ খৃষ্টাব্দে মারা যান। তাঁর সিংহাসনারোহণ ঘটেছিল ৩৪০ থেকে ৩৫০ খৃষ্টাব্দের মধ্যে কোন সময়ে। কেউ কেউ তাঁকে ৩২০ খৃষ্টাব্দের গুপ্তাব্দের প্রতিষ্ঠাতা বলেও মনে করেন। এ মত সঠিক নয়।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .