হরপ্পা সভ্যতার পতনের কারণ
হরপ্পা সভ্যতার সমাপ্তি যদি হঠাৎত্ত হয়ে থাকে তাও এর ক্রমিক অবক্ষয় দীর্ঘদিন ধরে চলেছিল। এই সভ্যতার বিভিন্ন স্থানে আবিস্কৃত শেষ পর্যায়ের চিত্রে তার চিহ্ন খুবই স্পষ্ট। বৃহৎ অট্টালিকা সমূহের স্থান অধিকার করেছিল, পুরনো ইটের তৈরী ছোট বাড়ি। এই বাড়িগুলি অনেক ক্ষেত্রেই রাস্তার উপরে এসে পড়েছিল। জল সরবরাহ ব্যবস্থা সংস্কারের অভাবে প্রায় ভেঙ্গে পড়েছিল। বাণিজ্য ও মৃৎশিল্প তার পূর্ব গৌরব হারিয়েছিল। পূর্বে যে সংস্থা গৃহ নির্মাণ ও পৌর শাসন নিয়ন্ত্রণ করত তার কর্তৃত্ব ও শিথিল হয়েছিল। এর থেকে মনে করা হয় যে হরপ্পা সংস্কৃতির ক্রমাবনতি একটি স্বীকৃত সত্য।
আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় বৈদেশিক আক্রমণের ফলে এই সভ্যতার অবসান হয়। কিন্তু কেবলমাত্র বিদেশী আক্রমণ এ কাজ করতে পারে না—সে শুধুমাত্র পতনকে ত্বরান্বিত করতে পারে। মার্টিন হুইলার মনে করেন যে কোনও বিদেশি শত্রুর আক্রমণের ফলে এই সভ্যতার পতন ঘটেছিল। পন্ডিত ওয়েলস তার গ্রন্থে আর্য আক্রমনের কথা উল্লেখ করেছেন। সিন্ধুর অন্তর্গত ঝুকার প্রাপ্ত শীলের উপর কুঠারের প্রতিছবি দেখে এই সভ্যতার ধ্বংসকারীরা আর্য বলে অনুমান করেছেন। অধ্যাপক ব্যাসাম আর্য আক্রমণের কথা বললেও তিনি এই সভ্যতার পতনের জন্য ভ্রাম্যমান কোন অশ্বারোহী মানুষের দলকে দায়ী করেছেন। ঋগ্বেদে হরি সুপির (হরপ্পা) যুদ্ধের উল্লেখের মধ্যে কিছু ঐতিহাসিক আর্যগণ এবং সিন্ধু উপত্যকার মানুষের মধ্যে তীব্র সংঘর্ষের তথ্য খুঁজে পেয়েছেন। তাছাড়া ঋগ্বেদে পরস্পর ইন্দ্র যে ধরনের দুর্গ বা পুর ধ্বংস করেছিলেন বলা হয়েছে তার অনেকটা মিল এই সভ্যতার মধ্যে পাওয়া গেছে। কালানুক্রমে দিক থেকে আর্য আক্রমণ এবং হরপ্পা সংস্কৃতির অবসান এই দুইটি ঘটনাকে ধারাবাহিক ভাবতে খুব একটা অসুবিধা হয় না। এই কারণেই হুইলার বলেছেন ইতিহাসের দরবারে আর্যগণ হরপ্পা উপত্যকার সভ্যতার ধ্বংস কারীরূপে অভিযুক্ত। কিন্তু এই মত সবক্ষেত্রে সত্য নয়। কারণ আক্রমণকারীরা সকলেই বৈদিক আর্য ছিল না। আক্রমণকারীদের অনেকেই বেলুচিস্তান থেকেও এসেছিল।
হরপ্পার অন্তিম পর্বে এই সভ্যতার পতনের অন্যতম কারণ ছিল রক্তপাতের মধ্য দিয়ে। মহেনজোদারোয় প্রাপ্ত স্তূপীকৃত কঙ্কাল এবং একটি কুয়োর ধারে সিঁড়ির উপর পাওয়া একটি নারী দেহের কঙ্কাল তাদের অস্বাভাবিক মৃত্যুর স্মারক হয়ে আছে। অনেকের মাথায় খুলিতে ভারি অস্ত্রাঘাতের চিহ্ন মৃত্যুর ভয়াবহতা ঘোষণা করেছে। কিন্তু এই রক্তপাত কেন হয়েছিল কারা ঘটিয়েছিল এই নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ আছে। কারো খতে গৃহযুদ্ধই এই রক্তপাতের কারণ। আবার কারো মতে বিদেশী আক্রমণকারীরা এই রক্তপাতের জন্য দায়ী। কোন কোন ঐতিহাসিক সিন্ধু উপত্যকার নগরগুলির ধ্বংসের কারণ হিসাবে সেখানকার ভেঙ্গে পড়া কৃষি ব্যবস্থার উপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব প্রদান করেছেন। কালক্রমে খালের মাধ্যমে জলসেচের ব্যবস্থাটি ভেঙ্গে পড়ে। এবং ভারি লাঙ্গলের ব্যবহার করে যে কৃষির উন্নতি করা যায় এই ধারণাটিও কালক্রমে লুপ্ত হয়েছিল। এছাড়াও বন্যার জল যে পদ্ধতির মাধ্যমে জলাধারে রাখা হত এবং পরে এই জল দিয়ে চাষ করা হত তার মাধ্যম ও ভেঙ্গে পড়েছিল—তাকে সচল করাও উদ্যোগ হারিয়েছিল হরপ্পাবাসীরা। এই ভাবে সেচব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে খাদ্যশস্য উৎপাদন ব্যবস্থা এবং দীর্ঘদিন অচল অবরোধে আবদ্ধ নগরগুলিও ভেঙ্গে পড়েছিল।
আবার অনেকে মনে করেন সিন্ধু ও অন্যান্য নদ-নদীর গতিপথ পরিবর্তনই সিন্ধু সভ্যতার পতনের প্রধান কারণ। এই সময় সিন্ধু নদীর গতিপথ নতুন খাতে বইতে থাকে। এর ফলে মোহেনজোদড়োর বন্দরের গুরুত্ব হারায়। এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে জলাভাব দেখা দেয়। তৎসহ কৃষি ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে। হয়ত নতুন খাল কেটে জলসেচের সমস্যার সমাধান করা যেত কিন্তু সভ্যতার অধিবাসীরা সেই দিকে দৃষ্টিপাত করে নাই। এর সাথে সাথে শতদ্রু, যমুনা, দূষদ্বতী ও সরস্বতী নদীতে জলাভাব দেখা দেয়। প্রসঙ্গত স্মরণীয় যে হরপ্পা সভ্যতার বিকাশে সরস্বতী ও দূষদ্বতী নদী দুইটির অববাহিকা অঞ্চলে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল কৃষিজ খাদ্যভান্ডার রূপে। এছাড়াও পশুচারণের পক্ষেও স্থানটি বিশেষ গুরুত্ব পূর্ণ ছিল। কিন্তু নদীগুলি গতিপথ পরিবর্তন এবং ক্ষীয়মান হতে থাকায় হরপ্পা সভ্যতার বসতিগুলিতে গভীর সঙ্কট ঘনিয়ে আসে।
কেউ কেউ বলেন, জলবায়ু রুক্ষতা ও মরু অঞ্চলের সম্প্রসারণের ফলে ঔ অঞ্চল মানুষের বসবাসের অনুপযোগী হয়ে ওঠে। মোহেনঞ্জোদাড়ো, হরপ্পা প্রভৃতি শহরের বাড়িগুলি সাধারণত পোড়া ইট দিয়ে তৈরি হত। ইটের জ্বালানির জোগান দিতে গিয়ে নিকটবর্তী বনাঞ্চল বৃক্ষহীন হয়ে পড়ে। এর ফলে বৃষ্টিপাত হ্রাসপায় ও মরু অবস্থার সৃষ্টি হয়। ফলে মানুষ ও গৃহপালিত পশুদের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্যশস্য ও উদ্ভিজ্জ সামগ্রীর উৎপাদন ব্যহত হয়। এ অঞ্চল মনুষ্যবাসের অনুপযোগী হয় এবং হরপ্পা সভ্যতার পতন অনিবার্য হয়ে পড়েছিল।
হরপ্পা সভ্যতার পতন প্রসঙ্গে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কথাও বলা হয়ে থাকে। অনেক ইতিহাসবিদ বন্যার প্রকোপকে সিন্ধু সভ্যতার ধ্বংসের প্রধান কারণ রূপে চিহ্নিত করেছেন। প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ থেকে জানা যায় হরপ্পা অন্তত তিনবার প্রবল বন্যায় ভেসে গিয়েছিল। বন্যা থেকে রক্ষা পাবার জন্য তারা নগরদুর্গকে ১৩.১ মিটার চওড়া একটি বাঁধ নির্মাণ করেছিলেন। বুধঠক্রবার ও লোথালে পলি অবক্ষেপ দেখা গেছে, যা সাধারণত প্রবল বন্যার ফলেই সৃষ্টি হয়ে থাকে। যার ফলে হরপ্পা সভ্যতার জনবসতি ধ্বংস হয়।
অধ্যাপক রেইকস বলেন সাধারণ বন্যা নয় ভূ-পৃষ্ঠের পরিবর্তন জনিত একটি ভয়ঙ্কর বন্যায় হরপ্পা সভ্যতাকে ধ্বংস করেছিল। ভূ-আলোড়নের ফলে উপকূল ভূমি হঠাৎ সমুদ্রতল হতে উপরে উঠে আসে। এর ফলে যে মহাপ্লাবন ঘটে তার ফলে হরপ্পার বাণিজ্য কেন্দ্রগুলি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। রাশিয়ার প্রত্নতাত্ত্বিকরা বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণ করে বলেছেন একটি বিশাল উল্কা পাত হওয়ার ফলে এই সভ্যতার আংশিক সম্পূর্ণ রূপে ধ্বংস প্রাপ্ত হয়েছিল।
পরিশেষে বলা যেতে পারে এই সভ্যতার রক্ষণশীল মানসিকতাই তাদের পতনের প্রধান কারণ ছিল।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .