প্রাচীন ভারতে ৬০০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ থেকে নাগরিক বসতির শুরু। অথচ খ্রীষ্টপূর্ব ৫৫১০ থেকে ২২৩০ অব্দের মধ্যে সিন্ধু উপত্যকায় প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়েছিল, বড় বড় তৃণভূমি ও বনাঞ্চলের অস্তিত্ব ছিল এবং সেই ‘আর্দ্রপর্ব’ কৃষি-বিপ্লব ঘটিয়ে সিন্ধুর নগরায়নকে সাহায্য করেছিল। রাজস্থানের ‘সরোবর সংক্রান্ত’ গবেষণা থেকে গুরদীপ সিং এই সিদ্ধান্তে উপনিত হন যে হয়তো থর মরুভূমি এলাকার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, কিন্তু মোটের উপর হরপ্পা সংস্কৃতির পরিণতি ও বিস্তার পর্যন্ত যে পরিবেশ মানুষের প্রতিকূলে যায়নি, তা বোঝা গেছে। সিন্ধু যুগেও বড় বড় বনবাসী প্রাণী, গৃহপালিত পশু ও প্রচুর সংখ্যায় ‘জেবু’ (বুনো গরু) যে ছিল, যা প্রমাণিত হয়েছে ফসিল বিশ্লেষণে সূত্রে। অনেকে ‘আর্দ্র’ যুগ-এর পর একটি শুষ্কদশা এসেছিল বলে মনে করেন। কিন্তু তা যদি এসেও থাকে, তাহলেও কিন্তু তা বসতির পক্ষে বিপজ্জনক হয়নি, অচিরেই অনুকূল পরিবেশ ফিরে এসেছিল। সিন্ধু অঞ্চলের সামুদ্রিক বাণিজ্য, বাহাওয়ালপুর পর্যন্ত বিস্তৃত ঘগ্গর-হাক্রা নদীপথ কিংবা লোথাল বা ধোলাভিরার মতো বন্দর শহর -এ সবই নদী-সমৃদ্ধ অনুকূল পরিবেশের সাক্ষ্য দেয়।
সম্প্রতি দুই প্রত্ন-আবহবিজ্ঞানী অনিল গুপ্ত ও ডেভিড অ্যান্ডারসন, ঐতিহাসিক পুরাতাত্ত্বিক ও ভূবৈজ্ঞানিক নানা প্রামান্য তথ্য ঘেঁটে তারা দেখেছেন যে, হরপ্পা সংস্কৃতির মূল অনুঘটক ছিল অবশ্যই অনুকূল আবহাওয়া। প্রচুর বৃষ্টিপাত, মনোরম জলবায়ু ও উর্বর জমি—এই তিন উপাদানের মেল-বন্ধনই ছিল হরপ্পার নগরায়ণের ভিত্তি।
তাহলে হরপ্পার পতনের জন্যে কি প্রতিকূল আবহাওয়া দায়ী ছিল না? গুপ্ত এবং অ্যান্ডারসন মনে করেন, ছিল, কিন্তু তার কারণ প্রত্নবসতি বা নগরায়ন নয়, কারণ ছিল অন্যত্র। সেটা তাঁরা খুঁজে পেয়েছেন ওমানের অনতিদূরে আরব সাগরের তলদেশ থেকে উদ্ধার করা পাললিক শিলায়। ঐ শিলায় লুকিয়ে থাকা জলজ উদ্ভিদের জীবাশ্ম পরীক্ষা করে তারা গত দশ হাজার বছরে দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে মৌসুমী বায়ুর গতিপ্রকৃতির হদিস পেয়েছেন।
ঐ জীবাশ্ম থেকে জানা গেছে যে, খ্রীষ্টজন্মের ছ’হাজার বছর আগেও সিন্ধু সভ্যতার মূল কেন্দ্র পাকিস্তানের মেহেরগড় সংলগ্ন অঞ্চলের আবহাওয়া যথেষ্ট আর্দ্র ছিল, আর বৃষ্টিপাতের পরিমাণও ছিল চাষবাসের পক্ষে ভাল। কিন্তু হাজার চারেক বছরের মধ্যেই জলবায়ুর চরিত্র বদলে যায়, মৌসুমী বায়ু দুর্বল হয়ে পড়ে, পরিবেশ কঠিন হয়ে যায়। কিন্তু এর জন্য দায়ী হরপ্পা নয়।
গুপ্ত ও অ্যান্ডারসনের ধারণা, আবহাওয়ার এই ভোল বদলের কারণ ছিল উত্তর আটলান্টিক অঞ্চলের জলস্রোতের পরিবর্তন। ভারতীয় উপমহাদেশের বৃষ্টিপাত ঘটত যে মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে তার উৎস ছিল উত্তর আটল্যান্টিকের উষ্ণ জলস্রোত। সম্ভবত ঐ অঞ্চলের বনধ্বংসের কারণে তাপমাত্রা হঠাৎ বেড়ে যায়। এবং উষ্ণ জলস্রোত বিপরীত পথে চালিত হয়। এর প্রভাবেই সিন্ধু উপত্যাকার পতন ঘনিয়ে আসে।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .