ভারতের প্রত্নোপলীও যুগের অবস্থান ও বৈশিষ্ঠ্য
ভারতের প্রত্নোপলিও যুগের আয়ুধ প্রথম আবিষ্কার করেন ব্রুশফুট (Brucefoote), ওল্ডহাম (Oldham)। সর্বপ্রথম এই যুগের অস্ত্র আবিস্কৃত হয় ১৮৬৩ খৃঃ মাদ্রাজের নিকট “মল্লরয়ম” নামক স্থানে। এরপর আবিষ্কৃত হয় বর্তমান পাকিস্তানের রাওলপিন্ডির নিকট সোয়ান নদী উপত্যকা এবং ভারতের তামিলনাড়ু, গুজরাট, মহারাষ্ট্র, অন্ধ্রপ্রদেশ ও রাজস্থানের অনেক স্থানে, বিপাশা ও বনগঙ্গা নদীর উপত্যকা, ওড়িষার কৃষ্ণা, সবরমতী ও নর্মদা নদী সমূহের উপত্যকায় এবং পশ্চিমবঙ্গের অজয়নদীর তীরে পান্ডুরাজার ঢিপি ও মুর্শিদাবাদের সারগাছী অঞ্চলে। বিলাসপুর, দৌলতপুর, দোহরা, গুলার ও লালগড়ে প্রত্নোপলিও যুগের কৃষ্টির বিশিষ্ট কেন্দ্র ছিল। গুলারে পাঁচটি স্তর আবিষ্কৃত হয়েছে। কুরলুল জেলার বিপ্লসুগম গুহাপুঞ্জের অস্তি নির্মিত আয়ুধ পাওয়া গেছে।
ভারতের প্রত্নোপলিও যুগের কেন্দ্র সমূহে যে সকল আয়ুধ পাওয়া গেছে, তার মধ্যে আছে হাতকুঠার, মাংসকাটার যন্ত্র, চাঁচবার যন্ত্র, ইত্যাদি। অধিকাংশ অস্ত্রই কোয়াট জাইট পাথর দিয়ে তৈরী হত।
মধ্য প্রত্নপোলিয় যুগের আয়ুধ সমূহ পাওয়া গেছে পাকিস্তানের সিন্ধু নদের উপশাখা সোয়ান নদীর চত্বরে। উত্তর ভারতের বিপাশা নদী উপত্যকা, পূর্ব ভারতের আসাম, বাংলা, ওড়িশা, মধ্য ভারতের নর্মদা উপত্যকার আদমনগর পাহাড়ে, জব্বলপুর অঞ্চলে ডেরাঘাটে এবং পান্ডব জলপ্রপাত ও বনঙ্গা নদী চত্বরে। দাক্ষিণ্যেতের এই যুগের আয়ুধ পাওয়া গেছে মহারাষ্ট্রের নেভাসা, মুম্বাইয়ের খান্ডিবাল অঞ্চলে। নর্মদা নদীর গুন্ডিয়া এবং ব্রহ্মশ্ররমে, মাদ্রাজের নিকট অত্তিরমপক্কমে। অন্তিম প্রত্নোপলিও যুগের আয়ুধ পাওয়া গেছে পূর্ব ভারতের দামোদর নদীর উপত্যকায় অবস্থিত বীরভনপুরে, বর্ধমানে এবং মেদিনীপুর জেলায়, মধ্য ভারতের আদমগর পাহাড়, জব্বলপুরের ভেরাঘাট অঞ্চল এবং বরসিমলা প্রভৃতি অঞ্চলে। অধিকাংশ স্থলেই এই যুগের অস্ত্রগুলি ছিল অত্যন্ত ছোট এবং তাদের নির্মাণশৈলী ছিল অত্যন্ত মসৃণ।
ভারতের প্রত্নোপলীও যুগের বৈশিষ্ট্য
১) প্রত্নপোলির যুগের মানুষের একমাত্র আয়ুধ নির্মাণ দ্বারাই নিজেদের শক্তিমান করে তোলেনি। তাঁরা নিজেদের আরো শক্তিমান করেছিল আগুনের ব্যবহার দ্বারা।
২) রাত্রিকালে তাদের আশ্রয়স্থলের চতুর্দিকে বা গুহামুখে রক্ষিত আগুন তাদের হিংস্রজন্তুর হাত থেকে রক্ষা করত। কিন্তু আগুনের ব্যবহার জানলেও, তারা নিজেরা আগুন তৈরী করতে জানত না।
৩) আদিম মানব গোষ্ঠীর মধ্যে ‘নিয়ান ডারথাল’ প্রজাতির মানুষরা আয়ুধ নির্মাণের সাথে সাথে আগুনের ব্যবহার শিখেছিল। এবং তাদের মধ্যে ধর্মের বিকাশ ঘটেছিল। তারা মৃতকে কবরাস্থ করত এবং কবরের ভিতরে মৃতের সাথে তার ব্যবহৃত অস্ত্র ও অন্যান্য দ্রব্য সমাধিস্থ করত।
৪) এই সময়কার অধিকাংশ মানুষই যাযাবর জীবনযাপন করত। অর্থাৎ তাদের আবাসস্থলের চারিপাশের পশু সম্পদ শেষ হলে, অন্যত্র চলে যেত।
৫) ‘ক্রোম্যানিয়ন’ যুগের মানুষরা সেলাই করা চামড়ার পরিচ্ছদ ব্যবহার করা শুরু করে। এই যুগেই সূঁচ আবিষ্কৃত হয়। পরিকল্পনা করে নতুন নতুন অস্ত্র ও প্রয়োজনীয় দ্রব্য উদ্ভাবন করে এবং কালক্রমে সে দক্ষ কারিগর হয়ে দাঁড়ায়। তবে ৩৫০০০ খৃঃ পূর্ব থেকে ৪০০০ খৃঃ পূবঃ পর্যন্ত মানুষ আগেকার মতো খাদ্যের জন্য শিকারের উপর নির্ভরশীল ছিল। অর্থাৎ কৃষি ব্যবস্থার তখনও সার্বিক উন্নতি ঘটেনি।
৬) অন্তিম প্রত্নোপলিও যুগ ছিল মানুষের অগ্রগতির ইতিহাসে আবিষ্কারের যুগ। এই যুগেই মানুষ অস্ত্র শস্ত্র থেকে আরম্ভ করে জীবনচর্চার উপকরণ ও সহায়ক এমন সব জিনিস আবিষ্কার করল যা ছিল বিস্ময়ের বস্তু যেমন—পাতলা দু-মুখ ছুরি, খোদনযন্ত্র, সুঁচ, হারপুন, ধনুক, চামড়ার পোষাক ইত্যাদি এবং বন্যকুকুরকে গৃহপালিত পশুতে পরিণত করেছিল।
৭) এই যুগ থেকেই মানুষের সামাজিক জীবনের সূত্রপাত হল। বিভিন্ন জায়গায় গড়ে উঠল আয়ুধ নির্মাণ কারখানা। এই কারখানাগুলিই ছিল সেই যুগের মানুষের মিলন স্থল। পরস্পরের ঘনিষ্ঠতা বাড়ল, একে অপরের ডেরায় আমন্ত্রণ জানাল, এইভাবেই সমাজ বিন্যাসের পর্বের সূত্রপাত হল।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .