পাল ও সেন যুগের বাংলার সংস্কৃতি
প্রাচীন বাংলার সাংস্কৃতিক জাগরণে পাল ও সেন যুগে অভূতপূর্ব পরিবর্তন এসেছিল। অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও সামাজিক বিবর্তনের পথ ধরে বাংলার সংস্কৃতি বৈশিষ্ট্যে ও বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধির শিখরে আরোহণ করেছিল। তার কিছু তথ্য পরিবেশিত হল।
পালযুগের সাহিত্য
পালরাজাদের আমলে সংস্কৃত কাব্যচর্চা আরও প্রসার লাভ করেছিল। এই সময় বৈদিক সাহিত্য ব্যাকরণ, তর্ক, বেদান্ত প্রভৃতি বিষয়ে বাঙালী পন্ডিতরা খ্যাতি অর্জন করেন। এই যুগের বাঙ্গালী গ্রন্থকারদের মধ্যে চতুর্বেদজ্ঞ দর্ভপানি, রামচরিত কাব্যের রচয়িতা সন্ধ্যাকর নন্দী। অদ্বয় সিদ্ধি, তত্ত্বপ্রবোধ, সংগ্রহ টীকা, প্রভৃতি গ্রন্থের রচয়িতা শ্রীধরভট্ট, নিদান গ্রন্থের রচয়িতা মাধব। “দায়ভাগ” গ্রন্থের রচয়িতা জীমৃতবাহন বিশেষ স্মরণীয়। এই সময় অভিনন্দ নামে এক বাঙ্গালী কবির উল্লেখ পাওয়া যায়। তিনি “কাদম্বরী কথাসার” গ্রন্থ রচনা করেন। “ব্যবহার মাতৃকা”, “কালবিবেক” নামে আরো দুইটি গ্রন্থ রচনা করেন জীমূতবাহন। পালরাজাদের বৌদ্ধ ধর্মে পৃষ্ঠপোষকতার ফলে সহজিয়া ধর্ম সংক্রান্ত বহু গ্রন্থ রচিত হয়েছিল যার অধিকাংশই আজ বিলুপ্ত প্রাপ্ত।
চিকিৎসাশাস্ত্র
এই যুগে চিকিৎসা শাস্ত্রে কয়েকজন গ্রন্থকার খ্যাতি লাভ করেন। চরক ও সুশ্রুতের প্রসিদ্ধ টীকাকার ছিলেন বাঙ্গালী পন্ডিত ‘চক্ৰপানি’। তিনি চিকিৎসাসংগ্রহ, আয়ুর্বেদ্দীপিকা, শব্দচত্রিকা, দ্রব্য গুণসংগ্রহ প্রভৃতি গ্রন্থের রচয়িতা ছিলেন। আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের টীকাকার ছিলেন অরুণ দত্ত, বিজয় রক্ষিত ও ইঙ্গ সেন।
বৌদ্ধ উপাখ্যান
বাঙ্গালী বৌদ্ধ গ্রন্থকারদের মধ্যে ‘আর্যযুদ্ধ’ উপাখ্যান গ্রন্থের রচয়িতা শীলভদ্র, ‘বজ্রযান’ সাধন গ্রন্থের রচয়িতা ছিলেন পন্ডিত দীপঙ্কর এবং ‘তান্ত্রিক’ গ্রন্থের টীকাকার ছিলেন ‘প্রজ্ঞাবৰ্মন’ নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
সেনযুগের সাহিত্য
এই সময় পুনরায় সংস্কৃত সাহিত্যের ব্যাপক প্রসার ঘটে। রাজা বল্লাল সেন ‘দান সাগর’, ‘অদ্ভুত সাগর’, ‘আচার সাগর’, ‘প্রতিষ্ঠান সাগর’ নামে চারটি গ্রন্থ রচনা করেন। রাজা বল্লাল সেন গুরু অনিরুদ্ধ ভট্ট ‘হারলতা ও পিতৃদয়িতা’ নামে দুইটি গ্রন্থে হিন্দুদের নিত্যকর্মের বিস্তৃত আলোচনা করেছেন। সেনযুগের প্রসিদ্ধ কবি ছিলেন জয়দেব। তার রচিত ‘গীতগোবিন্দ’ উৎকৃষ্ট কাব্য রূপে আজও পরিচিত। এই সময়ের রাজসভা অলকৃত কবিরা হলেন হলায়ুধ, ধোয়া, উমাপতিধর, শরণ ও সর্বানন্দ। হলায়ুধ রচিত ‘ব্রাহ্মণ সর্বস্ব, মীমাংসা সর্বস্ব, বৈষ্ণব সর্বস্ব’ পন্ডিত সর্বানন্দের রচিত টীকা সর্বস্বত পুরুষোত্তম রচিত ‘ভাষাবৃত্তি’, ‘হারাবলী’, ‘বর্ণদেশনা’ (ভাষাতত্ত্ব সম্বন্ধীয় গ্রন্থ) ধোয়ী রচিত পবনদূত, উমাপতিধর রচিত চন্দ্রচূড় চরিত্র ইত্যাদি গ্রন্থগুলি সেন যুগের শ্রেষ্ঠ গ্রন্থরূপে বিবেচিত হয়ে থাকে।
এই সময় বৌদ্ধ ও শৈব আচার্যরা গান ও দোঁহা রচনা করেন। এইগুলি চর্যাপদ নামে পরিচিত। কৃষ্ণপদ বা কাহ্নপা অন্যতম চর্যাপদকার ছিলেন। এই পর্যন্ত মোট ৪৭টি চর্যাপদ পাওয়া গিয়েছে। এই চর্যাপদগুলির মধ্যে দিয়েই বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জন্ম হয় এবং এর প্রভাবেই পরবর্তী কালে বাংলার সহজিয়া গান, বাউলগান ও বৈষ্ণব পদাবলীর উৎপত্তি হয়েছিল।
পাল ও সেন আমলের ধর্ম
পাল ও সেন আমলে বাংলাদেশে বিভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতির পীঠ স্থান ছিল। পাল রাজাদের সময় বৌদ্ধধর্ম এবং সেনরাজাদের সময় ব্রাহ্মণ্যধর্মের বিশেষ প্রাধান্য লাভ করেছিল। পালরাজারা বহু বৌদ্ধ বিহার নির্মাণ করেন। ধর্মপাল কর্তৃক বিক্রমশীল বিহার ও সোমপুর বৌদ্ধবিহারের নাম স্মরণীয়। অষ্টম হতে দ্বাদশ শতকের মধ্যে বাংলা ও বিহারে বৌদ্ধধর্মের অনেক পরিবর্তন ঘটে। এই সময় বৌদ্ধ ধর্ম বাংলা হতে নির্গত হয়ে তিব্বত, যবদ্বীপ, সুমাত্রা ও মালয় প্রভৃতি দেশে বিস্তার লাভ করে। এই যুগের ধর্মে তন্ত্র মন্ত্রের অনুপ্রবেশ ঘটায় ব্রজযান, সহজযান, তন্ত্রযান, কালচক্রযান প্রভৃতি মতবাদের উদ্ভব ঘটে। আবার বৌদ্ধধর্ম ও ব্রাহ্মণ্যধর্মের মিলনে অবধূতমার্গ ও বাউলমার্গের উদ্ভব ঘটে। বৌদ্ধ দেবতা তারা ও হিন্দু দেবদেবী শিব, কালী দুর্গা প্রভৃতির ব্যাপক পূজার প্রচলন শুরু হয় এবং বহু মন্দির এই সময় নির্মিত হয়। এই সময় ব্যাপক হারে পাথরের বিষ্ণু মূর্তির নির্মিত হয়েছিল।
শিক্ষা
পালযুগের বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষাকেন্দ্র হল নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়। এছাড়াও এই সময় ওদন্তপুরী, বিক্রমশীলা, সোমপুরী, দেবীকোট জগদ্দল প্রভৃতি স্থানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। এই সময়ে বিখ্যাত পন্ডিত ও শিক্ষাবিদ ছিলেন শীলভদ্র, শীলরক্ষিত, অতীশ দীপঙ্কর, শ্রীজ্ঞান, আচার্য অভয়াকর গুপ্ত, রত্নাকর শান্তি, শ্রীধর। বুদ্ধজ্ঞানপাদ কল্যাণরক্ষিত প্রমুখ সেন যুগের শিক্ষক ছিলেন। শিক্ষার মাধ্যম ছিল সংস্কৃত ভাষা। সেন যুগের অন্যতম শিক্ষা কেন্দ্র ছিল ‘নবদ্বীপ’। এখানে বহু প্রাচীন ‘টোল’ গড়ে উঠেছিল।
ভাষার উন্নতি
এই যুগে সংস্কৃত, প্রাকৃত, ও সৌরসেনী অপভ্রংশ ছিল সাহিত্যের প্রধান তিনটি ভাষা। সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা ছিল ‘মাগবী’ অপভ্রংশ বাংলা ভাষা। এই ভাষার শ্রেষ্ঠ কবি ছিলেন স্বয়ম্ভু। এই সময় চর্যাপদ রচিত হয়। শ্রেষ্ঠ চর্যাপদ রচনা করেছিলেন লুইপাদ, ভূমকপাদ, শান্তিপাদ শবরপাদ, অরহপাদ, কাহ্নপাদ।
চিত্রকলা
রামপালের সময় রচিত ‘অষ্ট সহস্রিকা প্রজ্ঞাপারমিতা’ নামক পুথিতে অসংখ্য ছবি অঙ্কিত হয়েছিল। সাধারণত বজ্রযান ও তন্ত্রযান ধর্ম বিষয়কে কেন্দ্র করে ছবিগুলি অঙ্কিত।
শিল্পরীতি
পালযুগের ‘টেরাকোটা শিল্প’ স্থাপত্য শিল্পের মৌলিক প্রতিভার পরিচয় বহন করে। এই যুগের বিখ্যাত দুই শিল্পী ছিলেন ধীমান ও বীতপাল। এই যুগের অষ্ট ধাতুর ও কালো পাথরের তৈরী দেবদেবীর মূর্তিগুলি সৃজনশীলতার পরিচয় দেয় সেনযুগেও বহু শিল্পীর উদ্ভব ঘটেছিল। এদের মধ্যে শূলপানি উল্লেখযোগ্য। অন্য শিল্পীদের মধ্যে কর্ণভদ্র, বিষ্ণুভদ্র তথাগত সাগর, সূত্রধর প্রমুখের শিল্প প্রতিভা প্রসংসার দাবি রাখে। পাল যুগের শিল্প কীর্তিগুলির মধ্যে ঢাকা জেলার সপ্তম শতাব্দীর ব্রোঞ্জের স্তূপ, রাজশাহী পাহাড়পুরের ও চট্টগ্রামের বোওয়ারী অনুরূপ দুই স্তূপ, পাহাড়পুরের সত্যপীরের ভিটা বাঁকুড়ার বহুলার ইটের নির্মিত স্তূপ, বর্ধমানের ভরতপুরে বৌদ্ধ স্তূপ, সোমপুর বিহার, কুমিল্লার ময়নাবতী বহার উল্লেখযোগ্য। এই সময় বিভিন্ন স্থানে অনেক মন্দির নির্মিত হয়েছিল। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল পাহাড়পুরের পোড়ামাটির ইটের কাদার গাঁথুনী মন্দির, সোমপুর বিহারের মন্দির, পুরুলিয়া তেলকূপীর মন্দির ও নগর নবদ্বীপের বল্লালঢিপির মন্দির। এই সময়ের অধিকাংশ মন্দিরে আয়তন ছিল ছোট এবং রেখ রীতিতে নির্মিত এবং খুব মার্জিত ও সংযত রুচির পরিচায়ক ছিল।
ভাস্কর্য
পাল ও সেন আমলের প্রায় সবগুলি মূর্তি রাজমহল পাহাড়ের কষ্টিপাথরে তৈরি হত। পিতল ও অষ্টধাতুর তৈরী মূর্তিও ছিল। এই সময়ে অধিকাংশ মূর্তিই পৃষ্ঠপটযুক্ত ফলক উৎকীর্ণ থাকত এবং মূর্তিগুলিতে দেবদেবীর মানবিক রূপ প্রকাশ পেয়েছিল। এর ফলে মূর্তিগুলিতে পার্থিব ও দেবী ভাবের অপরূপ সমন্বয় ঘটেছিল এবং শাস্ত্রীয় বিধান অনুসারে মূর্তি নির্মিত হত।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .