প্রাচীন ভারতের অর্থনৈতিক জীবন
প্রাচীন ভারতের অর্থনৈতিক জীবন স্বচ্ছল ছিল। হরপ্পা সভ্যতার যুগে কৃষিপ্রধান জীবিকা হলেও, শিল্প, বাণিজ্য ইত্যাদিও ছিল। বৈদিক যুগেও কৃষি, পশুপালন, শিল্প ও বাণিজ্যকে মানুষ প্রধান জীবিকারূপে গ্রহণ করেছিল। বৌদ্ধ যুগে (৬০০-৩০০ খ্রিঃ পূঃ) কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্যে চরম উন্নতি ঘটেছিল। লোহার ব্যাপক প্রচলন এই যুগে আর্থিক উন্নতির প্রধান হলেও বুদ্ধের উদার ধর্মনীতির প্রভাব রয়েছে। এই যুগে শেঠী বণিক ও কুসীদজীবীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছিল। মৌর্যযুগের অর্থনীতি জানতে বিশেষভাবে সাহায্য করে কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্র’। অর্থনৈতিক জীবনে উন্নতির জন্য এই সময় দ্বিতীয় পর্যায়ে ভারতে নগরায়ণ হয়। মৌর্য অর্থনীতির মূল বৈশিষ্ট্য হল অর্থনীতির উন্নয়নের প্রতিটি স্তরে রাষ্ট্রের ভূমিকা ছিল। কৃষির উন্নতির জন্য এই যুগে নগরায়ণ সম্ভব হয়। শহরে প্রচুর গিল্ড ছিল। রাষ্ট্র এগুলি নিয়ন্ত্রণ করত। মৌর্যোত্তর যুগে বিশেষত সাতবাহনদের সময় জমিতে ব্যক্তিগত মালিকানা স্বীকৃতি পেয়েছিল। শকদের শাসনকালে ভারতের মানুষ মৌর্যদের মতো করভারে জর্জরিত ছিল না। কুষাণ যুগে ব্যাপক স্বর্ণমুদ্রার প্রচলন, ওই যুগের আর্থিক সমৃদ্ধির প্রমাণ দেয়। কারিগরি শিল্পের প্রগতির জোয়ার এসেছিল। পেরিপ্লাসে বর্ণিত আছে, ভারতের লোহা ও ইস্পাত এই যুগে আবিসিনিয়ার বিভিন্ন বন্দরে আমদানি করা হত। দক্ষিণ ভারতে মৌর্য যুগে মুদ্রা অর্থনীতি প্রধান বৈশিষ্ট্য হয়ে ওঠে। সাতবাহনরাজাদের সিসার মুদ্রা ‘পোটিন’ চোলদের স্বর্ণমুদ্রা ‘কাণ্ড’ এই সময় ব্যাপকভাবে চালু হয়। গুপ্তযুগেও কৃষি-শিল্প বাণিজ্য অব্যাহত ছিল। পাল ও সেন যুগে তা অব্যাহত ছিল।
উন্নত কৃষি অর্থনীতি
খ্রীস্টীয় ৩০০-৬০০ অব্দের মধ্যে ভারতে সামন্ত অর্থনীতির সূচনা ঘটেছিল। বেতনের পরিবর্তে জমিদানের রীতি থাকায় রাজার অধীনে প্রচুর সামন্ত কর্মচারীর উদ্ভব হয়। ঐতিহাসিক রোমিলা থাপারের মতে, ১০০ খ্রিঃ পর থেকে সামরিক প্রয়োজন বৃদ্ধি পায়। তাই রাজস্ব আদায় ও সামরিক দায়িত্ব ঠিক-ঠিক পালনের জন্য আরও বেশি করে জমি বা গ্রাম দান শুরু হয়। ওড়িশার গঙ্গরাজ অনন্তবর্মন বহু করমুক্ত গ্রাম দান করেছিলেন।
চালুক্যদের সময়ে শক্তিশালী সামন্তরা ‘মহামন্ডলেশ্বর’, ‘মহাসামন্ত’ প্রভৃতি উপাধি নিতেন। আর অপেক্ষাকৃত ছোটো সামন্তরা ‘ঠাকুর’, ‘রাজা’, ‘সামন্ত’, ‘ভোক্তা’ইত্যাদি উপাধি নিতেন। গুপ্ত যুগে সামন্ত ও উপসামন্ত শ্রেণি ছিল। তাই কৃষি মানুষের প্রধান জীবিকা হয়ে ওঠে। আর সেইজন্যই কৃষির উন্নতির নানা তথ্য আমরা পণ্ডিত মেধাতিথির ‘অভিধানরত্নমালা’ গ্রন্থে পাই। এই যুগের উন্নত কৃষিজ পণ্যের মধ্যে চাল, ডাল, সরষে, পাট, তুলো, নীল, সুপরি, নারকেল, খেজুর, পান, কলা, কাঁঠাল, লবঙ্গ ইত্যাদি প্রধান। মার্কোপোলোর মতে বাংলায় তখন উন্নত আঁশযুক্ত তুলো উৎপন্ন হত। আরবীয় রেশম ও গুটিপোকা চাষের উল্লেখ দ্বাদশ শতকে চর্যাপদগুলিতে আছে। গুপ্ত যুগে ‘অমরকোশে’ বারো প্রকার জমির উল্লেখ আছে। যেমন-ক্ষেত্র (কর্ষণযোগ্য), বাপক্ষেত্র (জলে ভিজা বীজ বপনে উত্তম), খিল (অকর্ষিত জমি), অপ্ৰহত (পতিত জমি), অপ্রদ (কাউকে না দেওয়া জমি), বাস্তুজমি, পশুপালনের জমি ইত্যাদি। কেউ বলেন এই সকল জমির মালিকানা রাজার ছিল। কেউ বলেন অন্যের ছিল, রাজার নয়।
শিল্প
কৃষি ছাড়া বৃহৎ শিল্প এই যুগে ভারতের সর্বত্র গড়ে উঠেছিল। এর মধ্যে সুতিশিল্প, পশমশিল্প, রেশমশিল্প, বিভিন্ন ধাতুশিল্প, মৃৎশিল্প, চর্মশিল্প, দারুশিল্প, জাহাজ নির্মাণ শিল্প ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। ঐতিহাসিক মিনহাজউদ্দিন সিরাজের মতে, লক্ষণসেন সোনার থালায় খেতেন। অলংকারশিল্পে সোনা, রূপা, পাথর, মণিমুক্তার ব্যবহার হত।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .