আফিং বা আফিম যুদ্ধের চরিত্র নিয়ে গবেষকদরে মধ্যে বিতর্কের অন্ত নেই। মূল বিতর্কটা হলো এই যুদ্ধে আফিং এর ভূমিকা কী ছিল, তা নিয়ে। আফিং কি এই যুদ্ধের আশু কারণ, না প্রধান কারণ ছিল। – এই নিয়ে বিভিন্ন ঐতিহাসিক নিজ নিজ মত ব্যক্ত করেছেন।
মার্কিনী গবেষক কে. কে. ফেয়ারব্যাংকের (Trade and Diplomacy on the Chinese coast) মতে, যুদ্ধের কারণ আফিং নয়, অন্য কিছু। তাঁর মতে, যুদ্ধের মূল কারণ সমান কুটনৈতিক মর্যাদা, অবাধ বাণিজ্য, কাওটাও প্রথার অবসান প্রভৃতি। এই সমস্ত কারণই চিন ও ব্রিটেনকে যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয়। তাই আফিং ছিল যুদ্ধের আশু কারণষ কখনই মূল কারণ নয়।
চিনা গবেষক তান চুং এই মতের বিরোধিতা করেছেন। তিনি বলেছেন, ফেয়ারব্যাংক বিবৃত এইসব তথাকথিত মূল কারণ ১৮৩৮ সালের ‘অন্তত একশ’ বছর আগে থেকে ছিল, কিন্তু তখন দুটি দেশের মধ্যে কোন যুদ্ধ ঘটেনি। একমাত্র যখন মাঞ্জু সরকার আফিং বাণিজ্যের বিরুদ্ধে (ব্রিটেনের বিরুদ্ধে নয়) যুদ্ধ ঘোষণা করলো তখনই চিন-ব্রিটেন সমস্যার তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। তান চুং এর মতে, ব্রিটেন ও চিনের মধ্যেকার সম্পর্কের ক্ষেত্রে আফিং নির্ধারক ভূমিকা পালন করেছিল। এই পণ্যদ্রব্যকে কেন্দ্র করে ভারত চিন ও ব্রিটেনকে নিয়ে একটা ত্রিকোণ বাণিজ্য গড়ে ওঠে। ভারতবর্ষ থেকে চিনে আফিং রপ্তানি হতো এবং চিনের বাজারে বিক্রি হতো। বিক্রির ফলে যে বিপুল পরিমাণ রৌপ্য ব্রিটিশ চোরাকারবারীরা পেতো, তার একটা অংশ ব্যয় হতো চিনের চা, রেশমজাত দ্রব্য এবং পোর্সেলিন দ্রব্য কেনার জন্য। এইসব চিনা দ্রব্য ব্রিটেন সহ ইউরোপের বাজারে বিক্রি হতো প্রচুর মুনাফার বিনিময়ে। আফিংকে কেন্দ্র করে তিনটি দেশের মধ্যে এই ‘ত্রিকোণ বাণিজ্য’ (triangular trade) গড়ে উঠেছিল। গ্রীণবার্গের মতো (British Trade and the opening of China) আফিং শুধু আন্তঃএশীয় বাণিজ্য নয়, আন্তঃমহাদেশীয় বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তান চুং-এর মতে, এই বাণিজ্য বিপন্ন হওয়ায় ব্রিটেন আফিং যুদ্ধ শুরু করে। তাই আফিং এই যুদ্ধের আশু কারণ নয়, বরং প্রকৃত কারণ। চিনা কর্তৃপক্ষ যে যুদ্ধ শুরু করে, তা ব্রিটেনের বিরুদ্ধে নয়, বরং আফিং বাণিজ্যের বিরুদ্ধে । তাই তাদের যুদ্ধ প্রকৃতপক্ষে ছিল ‘আফিং বিরোধী’ যুদ্ধ (anti-opium war)। এর প্রত্যুত্তরে ব্রিটেন যে যুদ্ধ করে, তার উদ্দেশ্য ছিল চিনের শুরু করা যুদ্ধকে নাকচ করা। তাই তান চুং-এর মতে ‘আফিং যুদ্ধ’ কথাটি ভুল নয়, কারণ তা প্রকৃতপক্ষে আফিং বিরোধী— বিরোধী যুদ্ধ (anti-opium war) এবং দুটি ‘বিরোধী’ (anti) পরস্পরকে কাটাকাটি করলে যা থাকে, তা ‘আফিং যুদ্ধ’। তাই আফিংকে কেন্দ্র করে সংঘটিত এই যুদ্ধকে ‘আফিং যুদ্ধ’ বলাটাই সঙ্গত। পরবর্তীকালে তান চুং তাঁর পূর্বেকার ব্যাখ্যার কিছুটা পরিবর্তন করেন। প্রথম দিকে চিনা কর্তৃপক্ষ আফিং বাণিজ্যের বিরোধিতা করেনি, ফলে ক্যান্টন বন্দরে প্রকাশ্যেই এই নেশাদ্রব্যের বেচাকেনা চলতো। কিন্তু ১৮২০ সাল থেকে চিনা সরকার আফিং বণিকদের বন্দর থেকে সরিয়ে দেয়, আর ১৮২১ সাল থেকে ব্রিটিশ আফিং কারবারীরা বলপ্রয়োগের মাধ্যমে চিনে আফিং রপ্তানি করতে থাকে। নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও আফিং রপ্তানি করার অর্থ আনুষ্ঠানিক ভাবে যুদ্ধ ঘোষণা না করেও প্রকৃত অর্থে ব্রিটেন আফিং যুদ্ধই ঘোষণা করে। প্রথম ইঙ্গ চিন সংঘর্ষের বিবর্তনকে তাই চুং এইভাবে ব্যাখ্যা করেছেন—
১৮২১ – চিনের বিরুদ্ধে ব্রিটেনের আফিং যুদ্ধ।
১৮৩৯ – ব্রিটিশ আফিং চোরাকারবারীদের বিরুদ্ধে ‘চিনের আফিং বিরোধী যুদ্ধ’।
১৮৪০ – চিনের বিরুদ্ধে ব্রিটেনের আফিং বিরোধী – বিরোধী যুদ্ধ।
তাং চুং এখানেই থেমে থাকেনি, তিনি ব্রিটেনের সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পরিপ্রেক্ষিতে আফিং বাণিজ্যের গুরুত্ব আলোচনা করেছেন। ব্রিটেনের মূল উদ্দেশ্য ছিল ভারতীয় রাজস্বকে কক্ষিগত করা এবং তাকে ব্রিটেনে পাঠানো। রাজস্ব আত্মসাৎ করার এই পরিকল্পনায় চীনের প্রাসঙ্গিকতা ছিল এখানে যে, ইংল্যান্ড ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী চীনা ভূখণ্ডকে ভারত থেকে ব্রিটেনে রাজস্ব পাঠানোর মধ্যবর্তী স্টেশন হিসাবে ব্যবহার করতে চেয়েছিল। ১৮২০ এর দশকে ভারত থেকে যে পরিমাণ আফিং চীনে রপ্তানি হতো তা চীন থেকে ব্রিটেনে চা রপ্তানির পরিমাণের চেয়ে অনেক বেশী ছিল। বস্তুত পুরো ত্রিকোণ বাণিজ্য বিষয়টার মূলকথা হলো চীনাদের জন্য ভারতীয় আফিং, ব্রিটিশদের জন্য চিনের চা, আর ভারতীয়দের জন্য ব্রিটিশ শাসন। তান চুং-এর মতে তাই আফিং বাণিজ্য কোন সাধারণ বাণিজ্য ছিল না, এটা ছিল চিনের বিরুদ্ধে এক বাণিজ্যিক আগ্রাসন, যার দ্বারা চিনকে ব্রিটেনের সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার শরিক হতে বাধ্য করা হয়।
আফিং যুদ্ধে আফিং এর ভূমিকা নিয়ে চেং নামে এক চিনা গবেষক নতুন এক দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তাঁর মতে চীন ও ব্রিটেনের মধ্যেকার সংঘর্ষের মূল কারণ হলো ব্রিটেনের বাণিজ্য বিস্তার এবং চীনের পক্ষ থেকে তার বিরোধিতা। আফিং এই বিস্তারের ক্ষেত্রে একটা শকট হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছিল মাত্র। “যদি আফিং এর কোন কার্যকরী বিকল্প থাকতো, যেমন গুড় বা চাল, তবে এই যুদ্ধকে গুড়ের যুদ্ধ বা চালের যুদ্ধ বলা হতো” চেং মন্তব্য করেছেন।
চেং এর মতের বিরোধিতা করেছেন তান চুং। তাঁর মতে, যদি আফিংকে এইভাবে দেখা যায়, তবে তার ভূমিকা আলজেব্রার এক্স (X) ছাড়া অন্য কিছু হয় না। এই ধরনের মতামতে যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি অনুল্লিখিত থেকে যায়, তা হলো আফিং প্রকৃতপক্ষে শুধুমাত্র অন্য অনেক শকটের মতো একটা শকট ছিল না, একই সঙ্গে তা ছিল ইঞ্জিন, যা দুটি দেশকে সংঘর্ষের মুখে ঠেলে দিয়েছিল। আফিং না থাকলে পুরো ত্রিকোণ বাণিজ্যের চেহারাটাই পালটে যেতো। তদাই তাং চতুং এর মতে আফিং যুদ্ধকে এ যুদ্ধ (X-War) হিসাবে বর্ণনা করাটা অযৌক্তিক।
আমরা যদি তান চুং ও চেং এর মত বিচার করি, তবে দেখবে যে, উভয়ের বক্তব্যের মধ্যেই সত্যতা রয়েছে। চেং পুরো বিষয়টা একটা ব্যাপক ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের আলোকে বিচার করতে চেয়েছেন। এটা ঠিক যে, ব্রিটিশ বণিকদের চিনা ভূখণ্ডে আগ্রাসনের পুরো প্রক্রিয়াটাই পুঁজিবাদের বিকাশ, বৈদেশিক বাজার দখল ও ঐপনিবেশিক বিস্তারের প্রক্রিয়ার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। এটাও ঠিক যে আফিং না থাকলেও অন্য কোন ভাবে চিনদেশে ঔপনিবেশিক অনুপ্রবেশ ঘটতো। ভারতবর্ষে আগ্রাসন ও উপনিবেশ স্থাপনে আফিং এর প্রয়োজন হয়নি। এই দিক থেকে বিচার করলে পুঁজিবাদী আগ্রাসন মুখ্য এবং আফিং এর ভূমিকা গৌণ। আবার তান চুং-এর বক্তব্যেও সত্যতা আছে। পণ্যদ্রব্য হিসাবে আফিং চিনে আগ্রাসনের ক্ষেত্রে সত্যই যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। সেই ভূমিকা গুড় বা চালের পক্ষে পালন করা সম্ভব ছিল না। প্রাচ্যের দুনিয়ার ব্রিটেনের সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আফিং এর ভূমিকা অন্য কোন পণ্যদ্রব্যের পক্ষে পালন করা সম্ভব ছিল বলে মনে হয় না।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .