বৈদেশিক রাষ্ট্রসমূহের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে চিনাদের নিজস্ব একটি ধারণা ছিল। তাঁরা বিশ্বাস করতেন যে, পৃথিবীটা বর্গকার এবং স্বর্গ গোল। পৃথিবীর ঠিক মাঝখানে স্বর্গের গোল ছায়া পড়ে। সেই অঞ্চলটি স্বর্গের ঠিক নীচে অবস্থিত এবং এই অঞ্চল নিয়েই বিশ্বাস চিন সাম্রাজ্য গঠিত। এই সাম্রাজ্যের বাইরে বসবাসকারীরা সকলেই বিদেশি সর্বত্র বা দানব অথবা সামদ্রিক দৈত্য। সুতরাং “স্বর্গের সন্তান” চিন সম্রাট কখনোই এই বিদেশি বর্বরদের সাথে সমপর্যায়ে দাঁড়িয়ে বৈদেশিক সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে না। এই ধারণা থেকে চীনের সাথে প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহের সম্পর্ক গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে “নজরানা পদ্ধতি’ (Tribute System) প্রচলিত হয়েছিল।
নজরানা পদ্ধতি
চিন সম্রাট প্রাচীনকালে যখন সামন্ত প্রভুদের এবং ভূস্বামীবর্গকে জমি দিতেন, তখন তার বিনিময়ে সামন্ত প্রভু ও ভূস্বামীদের সম্রাটকে নজরানা (Tribute) পাঠাতে হত। সাধারণত এলাকায় উৎপন্ন পণ্য সামগ্রীর মাধ্যমে এই নজরানা পাঠাতে হত। পরবর্তীকালে চিন তার প্রতেবেশী দেশগুলির সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলার ব্যাপারেও এই পদ্ধতি অবলম্বন করে।
চিন তার দুর্বল প্রতিবেশীদের নিয়ে একটি “জাতিসমূহের পরিবার” (Family of Nations) গড়ে তুলেছিল। স্বাভাবিকভাবেই এই পরিবারের নেতৃত্বে ছিল চিন। অন্যান্য দেশগুলির মধ্যে ছিল কোরিয়া, লিউ-চিউ, আন্নাম (ভিয়েতনাম), শ্যাম, লাওস, ব্রহ্মদেশ প্রভৃতি। এই দেশগুলি সর্বদাই চিনের প্রাধান্য স্বীকার করে নিত। প্রাধান্যের স্বীকৃতি হিসাবে তারা চীন সম্রাটকে নানাবিধ উপঢৌকন নজরানা স্বরূপ পাঠাতে বাধ্য থাকত। এই প্রথাকেই চিনে নজরানা পদ্ধতি (Tribute System) বলা হত।
নজরানার পরিমাণ, কোন সময়ের ব্যবধানে নজরানা পাঠাতে হবে এবং কোন্ পথ ধরে নজরানা চিনে আসবে – এ সবই নির্ধারিত হত চিন সম্রাটের দরবারে। যে দেশের সাথে চিনের সম্পর্ক যত বেশি ঘনিষ্ট ছিল, সেই দেশকে তাত বেশি বার উপঢৌকন সমেত নজরানা পাঠাতে হত। কোরিয়া প্রতি বছর চার বার, লিউ – চিউ প্রতি তিন বছরে দু-বার, আন্নাম বা ভিয়েতনাম প্রতি দু-বছরে এক বার, শ্যাম বা থাইল্যান্ড প্রতি তিন বছরে এক বার, বর্মা ও ও লাওস প্রতি দশ বছরে এক বার করে চিন সম্রাটের দরবারে নজরানা পাঠাত। এই দেশগুলির নজরানা সমেত যে দল চিনে পাঠাত, সেই দলে প্রচুর সংখ্যক বণিক আসতেন বাণিজ্যপণ্য নিয়ে। এই বাণিজ্যপণ্যগুলির ওপর কোনো শুল্ক ধার্য করা হত না। তদুপরি নজরানাবাহী প্রতিনিধি দলের যাতায়াত সংক্রান্ত যাবতীয় ব্যয় চিন সরকার বহন করত। প্রতিনিধি দলের বণিকেরা এসে সেখানে থাকতেন, সেখানেই তাঁরা নিজ দেশের পণ্য বিক্রি করার জন্য চার-পাঁচ দিনের জন্য একটি বাজার খুলতেন। চিন সম্রাটের প্রাধান্য স্বীকার করে প্রতিবেশী করদ রাজ্যগুলি যখন নজরানা পাঠাত, সেই সময় তাদের বণিকেরা বাণিজ্যের মাধ্যমে প্রচুর লাভ করতেন। তাছাড়া, চিন সম্রাট নিজ উদারতার পরাকাষ্ঠা হিসাবে প্রতিনিধি দলের সদস্যদের প্রচুর মূল্যবান জিনিস উপহার দিতেন। একটি বিশেষ দিনে চিন সম্রাট বিদেশিদের কাছ থেকে নজরানা গ্রহণ করতেন। প্রতিনিধি দলের সদস্যরা চিনা রাজদরবারে দৈনিক “কাউ-টাউ” (Kow-Tow) প্রথায় নতজানু হয়ে চিন সম্রাটকে নজরানা দিতেন।
নজরানার পরিবর্তে প্রতিবেশী দেশগুলিতে চিনও নানা ধরনের উপহার প্রেরণ করত। সমগ্র “জাতিসমূহের পরিবারে” শান্তিশৃঙ্খলার রক্ষারদায়িত্বে ছিলেন চিন সম্রাট। করদ রাজ্যগুলিকে বৈদেশিক আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করতেন তিনি। এই সব দেশের নতুন রাজার অভিষেক অনুষ্ঠানে চিন সম্রাটের প্রতিনিধির উপস্থিতি অত্যাবশ্যক ছিল। এক কথায় বলা যেতে পারে, কোরিয়া, লাওস, বর্মা, লিউ-চিউ, শ্যাম, আন্নাম প্রভৃতি দেশের অভিভাবকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল চিন। চিন সেই সমস্ত দেশের সাথেই সম্পর্ক স্থাপন করত, যারা তার শ্রেষ্ঠত্ব মেনে নিত। চিন কখনোই সমতার ভিত্তিতে অন্য কোনো রাষ্ট্রের সাথে বৈদেশিক সম্পর্ক স্থাপন করত না। চিনে যারা বাণিজ্য করতে আসত, তারা মাঞ্জু সরকারের কৃপাধন্য হয়ে বাণিজ্য করত। তাই তারা কোনো অধিকার দাবি করত না।
এশীয় দেশগুলির মথ্যে পাশ্চাত্য দেশগুলিকেও চিনের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক রাখার ক্ষেত্রে নজরানা পদ্ধতি মেনে চলতে হত এবং “কাউ-টাউ’ প্রথানুযায়ী নতজানু হয়ে চিন সম্রাটকে উপঢৌকন দিতে হত। পর্তুগাল, হল্যান্ড, রাশিয়া এবং ব্রিটেনের রাষ্ট্রদূতদের এই প্রথা মেনে নিতে হয়েছিল। ১৬৫৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৭৯৫ খ্রিস্টাব্দে মধ্যে পাশ্চাত্য দেশগুলি চিনে মোট সতেরো বার তাদের প্রতিনিধি দল পাঠিয়েছিল। এর মধ্যে মাত্র একবারই “কাউ-টাউ” প্রথা অনুসৃত হয়নি।
ইউরোপীয় রাষ্ট্রদূত এবং বণিকরা অপমানজনক নজরানা পদ্ধতি উচ্ছেদ করার দাবি জানিয়েছিলেন। কিন্তু চিনা কর্তৃপক্ষ তাঁদের স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেয়—“তোমাদের কেউ এ দেশে আসতে বলেনি। যদি এসেই থাক, তবে এ দেশের প্রথা তোমাদের মানতে হবে।” তখন থেকেই ইউরোপীয় বণিকরা নজরানা প্রথার সক্রিয় বিরোধিতা আরম্ভ করেছিল।
করতাছাড়া, অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগ থেকে চিন বণিকেরা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে, যথা— শ্যাম, আন্নাম, মালাক্কা দ্বীপপুঞ্জ, মালয় উপদ্বীপ, জাভা প্রভৃতি অঞ্চলে পণ্যবাহী বাণিজ্য-জাহাজ নিয়ে পাড়ি দিতে আরম্ভ করে। এই ধরনের বাণিজ্য জাঙ্ক বাণিজ্য (Junk Trrade) নামে পরিচিত। Junk কথার অর্থ চিনদেশে বাণিজ্যে ব্যবহৃত এক বিশেষ ধরনের তরণী। চিনা বণিকদের সাথে বাণিজিক সম্পর্ক গড়ে তোলার ব্যাপারে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলিকে কোনো নজরানা দিতে হত না। সুতরাং জাঙ্ক বাণিজ্য ছিল নজরানা-প্রথা বহির্ভূত। তার ফলে নজরানা -প্রথার অস্তিত্ব ক্রমশ অর্থহীন হয়ে পড়েছিল।
নজরানা প্রথা ভিত্তিক সম্পর্ক রক্ষার বিষয়টি ছিল অত্যন্ত ব্যয়সাপেক্ষ। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে যে, কোরিয়া যখন চিনে নজরানা পাঠাত, তার ব্যয়ভার বহন করা চিনের পক্ষে কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কোরিয়ার রাজধানী সিউলের থেকে পিকিং এর দূরত্ব ছিল প্রায় ৭৫০ মাইল। যেতে সময় লাগত চল্লিশ থেকে ষাট দিন। নজরানাবাহী প্রতিনিধি দলে কমপক্ষে ২০০-৩০০ জন থাকতেন। সুতরাং এই নজরানা পাঠানোর জন্য কোরিয়াকে বিশদ বন্দোবস্ত করতে হত। করদ দেশগুলির রাজাদের অভিষেকের সময় চিনা রাজদরবারের প্রতিনিধিদের স্বাগত জানানোর ব্যাপারটিও খুবই ব্যয়সাপেক্ষ ছিল। এত খরচ করার মতো সঙ্গতি রাজ্যগুলির ছিল না। অনেক ক্ষেত্রে লিউ-চিউ এর শাসক তাঁর সিংহাসন আরোহণের প্রায় দু-তিন বছর পর চিনা প্রতিনিধিদের আমন্ত্রণ জানিয়ে নিজের অভিষেক অনুষ্ঠান সম্পাদন করতেন।
পাশ্চাত্য বণিকদের সক্রিয় বিরোধিতা, জাঙ্ক বাণিজ্যের প্রাধান্য এবং ব্যয়বহুলতা প্রকৃতপক্ষে ঊনবিংশ শতকের প্রথমদিকে নজরানা প্রথার অস্তিত্বকে বিভিন্ন করে তুলেছিল।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .