চিনে চিং শাসনকালে আঞ্চলিক শাসনব্যবস্থা
চিং শাসনকালে গোটা চিনদেশ ১৮টি প্রদেশে বিভক্ত ছিল। প্রদেশগুলি বিভক্ত ছিল ৯২ টি সার্কিটে। সার্কিটগুলি বিভক্ত ছিল ১৭৭ থেকে ১৮৫ টি প্রিফেচারে। আবার প্রিফেক্চারগুলি বিভক্ত ছিল প্রায় ১৫০০ জেলা ও ডিপার্টমেন্টে। ১৮টি প্রদেশের শাসনের দায়িত্বে থাকতেন গভর্নর জেনারেল ও গভর্নরেরা। চিহ্নলি এবং সেচওয়ান এই ২টি প্রদেশ নিয়ন্ত্রণে দায়িত্বে ২জন করে গভর্নর জেনারেল ছিলেন। কিন্তু অন্যান্য ক্ষেত্রে এক একজন গভর্নর জেনারেলের দায়িত্বে একাধিক প্রদেশ থাকত। গভর্নর জেনারেলের কাজে সাহায্য করতেন গভর্নরেরা। পিকিং এর রাজদরবার মাঞ্জু ও চীনাদের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় রেখে চলার পক্ষপাতী ছিল। যদি কোনো প্রদেশের গভর্নর জেনারেল মা হতেন, তবে সেই প্রদেশের গভর্নর অবশ্যই হতেন একজন চীনা। আবার অন্য ক্ষেত্রে ঠিক তার উল্টোটাই ঘটত। অষ্টাদশ শতকের অন্তিম লগ্নে শতকরা ৫৭ জন গভর্নর জেনারেল ছিলেন মাঞ্জু এবং শতকরা ৪৩ জন ছিলেন চীনা।
প্রত্যেক গভর্নরের অধীনে একজন করে অর্থসংক্রান্ত, বিচারবিভাগীয় এবং শিক্ষানীতি নির্ধারণ সংক্রান্ত কমিশনার থাকতেন। তাঁদের সকলকেই নিযুক্ত করতেন সম্রাট স্বয়ং। প্রত্যেক কমিশনারের অধীনস্ত কর্মচারীদের নিয়োগ করত সরকার। তবে তাঁদের বেশি কিছু ব্যক্তিগত কর্মচারীও ছিল। তাছাড়া বিভিন্ন অঞ্চলে লবন বাণিজ্য, শস্য পরিবহন, আবগারি, নদীপথে যাতায়াত ইত্যাদি বিষয় দেখাশোনা করার জন্য সরকার একদল বিশেষ কমিশনার নিযুক্ত করত। একজন প্রদেশিক সৈন্যাধ্যক্ষ এলাকার সামরিক বিষয়গুলির তত্ত্বাবধান করতেন।
আঞ্চলিক শাসনব্যবস্থার ক্ষেত্রে কমিশনারদের পরবর্তী স্তরে ছিল সার্কিট ইনটেনডেন্ট ও প্রিফেক্টদের স্থান। সার্কিট ও প্রিফেক্চারের পরবর্তী ক্ষুদ্রতর একক ছিল জেলা। জেলাগুলির প্রশাসনিক দায়িত্ব অর্পিত ছিল জেলাশাসকদের ওপর। জেলাশাসকদের কাজ ছিল কর আদায় করা, মামলা মোকদ্দমার নিষ্পত্তি করা এবং এলাকার আইন শৃঙ্খলা রক্ষা করা। জেলাশাসককে বলা হত ‘ফু-সু-কুয়ান’ বা ‘বাপ-মা পদাধিকারী’ (Father-Mother official)। জেলাশাসকদের সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ রেখে চলতে হত এবং তাদের চাহিদার প্রতি নজর রাখতে হত বলেই সম্ভবত তাদের উক্ত নামে ডাকা হত। স্থানীয় বিষয় সম্পর্কে ওয়াকিবহাল কোনো গোষ্ঠীর সঙ্গে জেলাশাসক ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ বজায় রাখতেন। এই গোষ্ঠী বেসরকারি স্থানীয় আমরা হিসাবে কাজ করে জেলাশাসককে প্রশাসনিক কাজে সাহায্য করত। এই গোষ্ঠী মোট ৬টি ভাগে (ফ্যাং) নিজেদের সংগঠিত করেছিল। সেই ভাগগুলি ছিল – (১) প্রশাসনিক ও অসামরিক বিষয় (২) আদমশুমার ও কর ব্যবস্থা (৩) রীতিনীতি ও উৎসব অনুষ্ঠান (৪) সামরিক বিষয় (৫) অপরাধ ও আইনশৃঙ্খলা এবং (৬) জনকল্যাণ। উপরোক্ত আমলারা জেলাশাসকের কাছ থেকে কোনোরকম বেতন পেতেন না। কিন্তু তাঁরা একধরনের অধিকার (surcharge) জনসাধারণের কাছ থেকে আদায় করতে পারতেন। এই আদায়ীকৃত অংশের একটা তারা জেলাশাসকের কাছে পাঠিয়ে দিতেন এবং অবশিষ্ট অংশ নিজেরা ভোগ করতেন।
জেলার থেকে সামান্য বড়ো শাসনতান্ত্রিক এককের অস্তিত্ব প্রাক্-আধুনিক চিনে ছিল। এগুলিকে বলা হত ডিপার্টমেন্ট বা চৌ এবং সাব-প্রিফেক্চার বা তিং। কতকগুলি ডিপার্টমেন্ট প্রাদেশিক সরকারের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণাধীনে ছিল। সাধারণ ডিপার্টমেন্টগুলি অপেক্ষা এই ডিপার্টমেন্টগুলি কিছুটা বেশি মর্যাদা উপভোগ করত।
প্রত্যেকটি জেলা আবার কতগুলি গ্রামে (চুয়াং), নগরে (চোং), শহরে (চেন, গ্রামভিত্তিক বসতি (শিয়াং) এবং গ্রামীন বাজার (শি) বিভক্ত ছিল। এই গ্রামীন এককগুলি শাসনের দায়িত্বে থাকতেন স্থানীয় অধিবাসীরা। সরকারি কর্মচারীরা গ্রামীণ শাসনের দায়িত্বে থাকতেন না বললেই চলে বস্তুত সামাজিক প্রশাসনিক ব্যবস্থা জেলাস্তরেই থেমে গিয়েছিল। যেহেতু গ্রামীণ স্তরে স্থানীয় অধিবাসীরা শাসনের দায়িত্বে থাকতেন, সেহেতু গ্রাম নগর ও শহরগুলি যথেষ্ট স্বায়ত্তশাসন উপভোগ করত। তবে সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি সময় দুটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সামাজিক সরকার আঞ্চলিক প্রশাসনে কিছুটা হস্তক্ষেপ করতে শুরু করেছিল। ১৬৪৪ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত পাও-ছিয়া পুলিশী ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করত এবং ১৬৪৮ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত লি-চিয়া কর আদায়ে সাহায্য করত।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .