ইংরেজদের সঙ্গে রণজিৎ সিংহের সম্পর্ক
রণজিৎ সিংহ মোগল সাম্রাজ্যের পতন ও ইংরেজ শক্তির সম্প্রসারণকালে পরস্পর বিবদমান মিসগুলিকে ঐক্যবদ্ধ করে সমগ্র পাঞ্জাবে শিখ সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন।
তিনি পিতার মৃত্যুর পর সুকারচুকিয়ার শাসনকর্তা নিযুক্ত হন। জামালশাহের পাঞ্জাব আক্রমণকালে রণজিৎ সিংহ তাঁকে নানাভাবে সাহায্য করেন এবং পুরস্কার স্বরূপ লাহোরের শাসনকর্তা নিযুক্ত হন। কিছুদিনের মধ্যেই জামালশাহের প্রতি আনুগত্য ত্যাগ করে নিজেকে লাহোরের স্বাধীন শাসকরূপে ঘোষণা করেন। অখিল শিখ সাম্রাজ্য গড়ে তোলাই ছিল তাঁর প্রধান রাজনৈতিক উদ্দেশ্য।
অখিল শিখ রাষ্ট্রগঠনের স্বপ্ন
রণজিৎ সিংহ অখিল শিখ রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন দেখতেন। সেই উদ্দেশ্যে ১৮০৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে তিনি অমৃতসর দখল করে শতদুর পশ্চিম তীরবর্তী রাজ্যগুলি জয় করেন। এরপর শতদ্রুর পূর্বতীরস্থ রাজ্যগুলি নিজের আয়ত্তে আনবার চেষ্টা করলে এই রাজ্যগুলি রণজিৎ সিংহের বিরুদ্ধে ইংরেজদের শরণাপন্ন হয়। এই পরিস্থিতিতে ইংরেজদের সামনে সুবর্ণ সুযোগ এনে দেয়। রণজিৎ সিংহের অখিল শিখ রাষ্ট্রগঠনের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হল না। গভর্নর জেনারেল লর্ড মিন্টোর আদেশে চার্লস মেটাকাফ আলাপ আলোচনার মাধ্যমে ১৮০৯ খ্রিস্টাব্দে অমৃতসরের সন্ধি করেন।
অমৃতসরের সন্ধি
অমৃতসরের সন্ধির শর্ত অনুযায়ী শতদ্রু নদী রণজিৎ সিংহের রাজ্যের পূর্ব সীমারেখা বলে স্থির হয়। শতদ্রু নদীর পূর্বতীরবর্তী রাজ্যগুলির ওপর ইংরেজদের আধিপত্য স্বীকার করে নেওয়া হয় ও উভয় পক্ষে স্থায়ী মৈত্রী বজায় রাখতে সম্মত হয়। এই সন্ধি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর রণজিৎ সিংহের পক্ষে আর শতদ্রু নদীর পূর্বতীরের রাজ্যগুলি জয় করা সম্ভব হয়নি। ঐতিহাসিক এন. কে সিনহার মতে, অমৃতসর সন্ধিতে আবদ্ধ রণজিৎ সিংহ অশ্ব ও ইংরেজ পক্ষ অশ্বারোহীর ভূমিকা গ্রহণ করেছিল।
আবার ক্যানিংহাম প্রমুখ ঐতিহাসিক মনে করেন অমৃতসর চুক্তি ইংরেজ ও রনজিৎ সিংহের মধ্যে শতদ্রু নদীর প্রাকৃতিক সীমারেখা নির্দেশ করে। এর ফলে রণজিৎ সিংহের পক্ষে মুলতান, বঙ্গ, কাশ্মীর, ডেরাইসমাইল খাঁ, ডেরা গাজি খাঁ, পেশোয়ার জয় করে সিন্ধুদেশ পর্যন্ত শিখ সাম্রাজ্য সম্প্রসারণ করা সম্ভব হয়।
চিরস্থায়ী ও ত্রিশক্তি মৈত্রী
১৮২৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে রণজিৎ সিংহের মৃত্যু (১৮৩৯) পর্যন্ত ইংরেজদের সঙ্গে সদ্ভাব বজায় ছিল। লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক লাহোরে এসে রণজিৎ সিংহের সঙ্গে চিরস্থায়ী মিত্রতা স্থাপন করেন। এই চুক্তির ফলে সিন্ধুদেশে রণজিৎ সিংহের আধিপত্য হ্রাস পায়। আফগানিস্তানের ক্ষেত্রে রণজিৎ সিংহ সফল কূটনীতির পরিচয় দিয়েছেন। সাময়িকভাবে তিনি এখানে নিজের আধিপত্য বিস্তার করতে সক্ষম হন। ১৮৩৮ সালে শাহ, সুজা, ইংরেজ ও রণজিৎ সিংহের মধ্যে ত্রিশক্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দে রণজিৎ সিংহের মৃত্যু হয়।
মূল্যায়ন
অনেক সমালোচক এই দাবি করেন যে রণজিৎ সিংহ শিখ রাজ্যের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার কোনো স্থায়ী ব্যবস্থা করতে পারেননি। সেটা সম্ভবও ছিল না। ইংরেজরা এদেশে যেভাবে আগ্রাসী নীতি নিয়ে চলছিল তাতে ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার ব্যবস্থা কোনোদিনই হত না। পার্সিভাল প্রমুখ ঐতিহাসিক মনে করেন রণজিৎ সিংহ আপসমূলক নীতি গ্রহণ করে। বাস্তব বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছেন। অমিত শক্তিশালী ইংরেজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে জয়লাভ করা সম্ভব হত না। সমসাময়িক পরিস্থিতির নিরিখে তিনি ছিলেন বাস্তববাদী, বিচক্ষণ, দূরদর্শী, দক্ষ রাজনীতিবিদ। শাসক হিসেবে তিনি দক্ষতা ও যোগ্যতার পরিচয় রেখেছেন। ড. জাকমো তাকে নেপোলিয়নের ক্ষুদ্র সংস্করণ বলে অভিহিত করেছেন।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .