ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবিস্তারে লর্ড ওয়েলেসলির অবদান
ঘোরতর সাম্রাজ্যবাদী লর্ড ওয়েলেসলি ভারতে গভর্নর জেনারেল হয়ে আসবার আগে তিনি ছিলেন বোর্ড অফ কন্ট্রোলের এক সফল সদস্য। সেই জন্য তার এদেশ সম্পর্কে সম্যক ধারণা ছিল। ভারতে এসেই তিনি ব্রিটিশ সাম্রাজ্য সম্প্রসারণে বিখ্যাত অধীনতামূলক মিত্রতা নীতি চালু করেন।
অধীনতামূলক মিত্রতা নীতি
অধীনতামূলক মিত্রতা নীতির শর্ত হল যে সমস্ত ভারতীয় রাজন্যবর্গ এই নীতির দ্বারা ইংরেজদের সঙ্গে মিত্রতা নীতৃিতে চুক্তিবদ্ধ হবেন তাদের সবরকম নিরাপত্তা দেবে ব্রিটিশ সরকার। চুক্তিবদ্ধ মিত্র রাজ্যে একদল ব্রিটিশ সৈন্য এবং একজন ইংরেজ রেসিডেন্ট নিযুক্ত হবে। সেই সৈন্যদলের ব্যয়ভার বহন করবে সংশ্লিষ্ট মিত্ররাজ্য। বড়ো রাজ্যগুলি সেই ব্যয়ভার বহনের জন্য রাজ্যের একাংশ ইংরেজদের হাতে তুলে দেবে আর ছোটো রাজ্যগুলি নগদ অর্থ প্রদান করবে। ব্রিটিশ সরকারের অনুমতি ছাড়া সংশ্লিষ্ট মিত্ররাজ্য কোনো দেশি বা বিদেশি শক্তির সঙ্গে কোনো যুদ্ধ বা চুক্তি স্বাক্ষর করতে পারবে না। ইংরেজ ছাড়া অন্য কোনো ইউরোপীয়কে কোনো কাজে তারা নিয়োগ করতে পারবে না। ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন বোনাপার্টের শক্তিবৃদ্ধিতে আতঙ্কিত হয়ে ব্রিটিশ কোম্পানি ভারতীয় রাজ্যগুলিকে এক অনুগত সামত্ত শ্রেণিতে পরিণত করতে চেয়েছিলেন।
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের উদ্দেশ্য
সমকালীন ভারতীয় রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভারতীয় রাজন্যবর্গের ভেদবুদ্ধি পরস্পর স্বার্থপরতা, অবিশ্বাস বিচক্ষণ ওয়েলেসলিকে এই ধরনের সাম্রাজ্যবাদী নীতি গ্রহণ করতে উদ্বুদ্ধ করেছে। ব্রিটেনের শিল্পপতি ও বণিক সম্প্রদায় ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য প্রসারে উৎসাহিত করেছে। তাদের স্থির বিশ্বাস ছিল ভারতে ব্রিটিশ শক্তির প্রসার ঘটলে ব্রিটেনের শিল্প কলকারখানার শ্রীবৃদ্ধি ঘটবে। ভারত একদিকে শিল্পের কাঁচামাল সরবরাহকারী দেশ এবং শিল্পজাত পণ্যের শ্রেষ্ঠ বাজার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে।
ভারতীয় শাসকদের মিত্রতা গ্রহণ
লর্ড শাসকদের ভারতীয় রাজাদের অধীনতামূলক মিত্রতা নীতি গ্রহণ করবার আহ্বান জানালে দেশীয় রাজন্যবর্গের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। মারাঠাদের কাছে পরাজিত সর্বশান্ত ভীত সন্ত্রস্ত হায়দরাবাদের নিজাম ১৭৯৮ খ্রিস্টাব্দে প্রথম এই নীতি গ্রহণ করেন। এর ফলে ব্রিটিশ সরকার কুয়া ও তুঙ্গভদ্রা নদীর অববাহিকা অঞ্চল লাভ করে। নিজাম ইংরেজদের বিশ্বস্ত অনুগত সেবকে পরিণত হয়। এর পর অযোধ্যার নবাব এই মিত্রতা নীতি গ্রহণ করলে দোয়াব, রোহিলাখণ্ড ও গোরখপুর ইংরেজদের হাতে তুলে দেন। তারপর একে একে পেশোয়া দ্বিতীয় বাজীরাও, বরোদার গাইকোয়াড়, তাঞ্জোর, সুরাট ও কর্নাটকের রাজারা অধীনতা মূলক মিত্রতা নীতি গ্রহণ করেন। রাজপুতানার যোধপুর ও জয়পুর রাজ্যও মৈত্রীবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পুরোপুরি ইংরেজদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।
এছাড়া চতুর্থ ঈঙ্গ মহিশূর যুদ্ধে টিপু সুলতান পরাজিত ও নিহত হলে মহিশুর রাজ্যের অধিকাংশ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত হয়ে যায়। এইভাবে কূটনীতি ও যুদ্ধনীতির দ্বারা লর্ড ওয়েলেসলি ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য সম্প্রসারণ করেন।
মূল্যায়ন
লর্ড ওয়েলেসলি ব্যক্তিগত উদ্যোগে যেভাবে ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সম্প্রসারণ ঘটিয়ে ছিলেন তা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মনঃপূত ছিল না। ইংরেজ ঐতিহাসিক রবার্টস্, মিল, বিভারজ প্রমুখ ওয়েলেসলির তীব্র সমালোচনা করেছেন। দুর্বল দেশীয় রাজ্যগুলি ব্রিটিশ শক্তির পক্ষে ক্ষতিকর ছিল না। তবু অযথা যুদ্ধ করে ওয়েলেসলি প্রচুর অর্থের অপচয় করেছেন বলে সমালোচকদের দাবি। তবু একথা অস্বীকার করা যাবে যে মহিশুর মারাঠা শক্তি ইংরেজদের যথেষ্ট চিন্তায় ফেলে দিয়েছিল। উপরন্তু নেপোলিয়ন ভারত আক্রমণ করলে ইংরেজদের বিপদ বাড়ত বৈ কমত না। লর্ড ওয়েলেসলি তাঁর যুদ্ধনীতি ও কূটনীতির দ্বারা ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিতকে মজবুত ও শক্তিশালী করে তুলেছিলেন স্বীকার করতেই হবে।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .