এশিয়া ও আফ্রিকার জাতীয় মুক্তি আন্দোলন
ইউরোপে আবির্ভাবের প্রায় এক শতাব্দী পর জাতীয়তাবাদের ভাবতরঙ্গ প্রথমে এশিয়া, পরে আফ্রিকার উপকূলে আছড়ে পড়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম পরিণতি হল বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন উপনিবেশে জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ও তদ্জনিত স্বাধীনতা আন্দোলন। আফ্রো-এশীয় অঞ্চলে উপনিবেশ বিস্তারকারী ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, হল্যান্ড প্রভৃতি রাষ্ট্র ফ্যাসিস্ট বা অক্ষশক্তির বিরুদ্ধে জয়লাভ করলেও নিজেদের পূর্বতন সাম্রাজ্য রক্ষা করতে পারেনি। ফলে এশিয়া-আফ্রিকার মাটিতে স্বাধীনতার পতাকা উড্ডীন হয়। সেই দিক থেকে বলা যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ মুক্তিসংগ্রামীদের কাছে নিয়ে এসেছিল মুক্তিলাভের এক সুবর্ণ সুযোগ।
এশিয়া দেশগুলির মুক্তি আন্দোলন
ভারত
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ভারতে ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রাম তীব্রতর হয়। ভারত ছাড়ো আন্দোলন, আজাদ হিন্দ ফৌজের সংগ্রাম, নৌবিদ্রোহ ব্রিটিশ শাসনের ভিত্তিমূলকে কাঁপিয়ে দেয়। ব্রিটিশ সরকার বাধ্য হয়ে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ আগস্ট ভারতের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে। কিন্তু ভারতকে ‘ভারত ও ‘পাকিস্তান’ নামে দুটি পৃথক রাষ্ট্রে দ্বিখণ্ডিত করে।
সিংহল
এই দেশ প্রথমে ব্রিটিশ কমনওয়লেথ রাষ্ট্রের মর্যাদা লাভ করে। পরে ১৯৪৭ সালে সিংহল স্বাধীন হয় এবং বর্তমান নাম হয় শ্রীলঙ্কা।
ব্রহ্মদেশ
১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে ব্রহ্মদেশ ভারত থেকে পৃথক হয়। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপান ব্রহ্মদেশ দখল করে। বর্মীদের প্রবল আন্দোলনে জাপানের পরাজয় ঘটলে, ব্রিটিশরা ব্রহ্মদেশ দখল করে। সবশেষে ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে ব্রয়দেশ স্বাধীনতা লাভ করে।
ইন্দোনেশিয়া
এই দেশ হল্যান্ডের পরাধীন ছিল। ড. সুকর্ণর নেতৃত্বে সেখানকার জাতীয়তাবাদী দল আন্দোলন শুরু করে। ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে জাপান ইন্দোনেশিয়া দখল করে। এই সময় ইন্দোনেশিয়ায় তীব্র জাতীয়তাবাদী আন্দোলন শুরু হয়। শেষপর্যন্ত রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদের সহায়তায় ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে ইন্দোনেশিয়া স্বাধীন হয়।
ইন্দোচিন (ভিয়েতনাম)
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের আত্মসমর্পণের পর ইন্দোচিন ফরাসিদের দখলে চলে যায়। সেখানে হো-চি-মিন-এর নেতৃত্বে জাতীয়তাবাসী আন্দোলন গড়ে ওঠে। ভিয়েতনামের সাধারণ মানুষের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের ফলে ফরাসি সরকার পিছু হটতে বাধ্য হয়। অবশেষে দিয়েন-বিয়েন ফুর যুদ্ধে ফরাসিদের পরাজয় ঘটে। ফরাসি ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যৌথ আক্রমণের মেকাবিলা করে ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে ইন্দোচিন স্বাধীন রাষ্ট্রের মর্যাদা লাভ করে।
আফ্রিকার জাতীয়তাবাদী মুক্তি আন্দোলন
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির পর থেকে আফ্রিকা মানবাধিকারের চেতনায় সমৃদ্ধ হয়। ফলে সমগ্র আফ্রিকায় জাতীয়তাবাদী মুক্তি আন্দোলনের জোয়ার আসে।
আলজিরিয়া
আলজিরিয়া একসময় ফ্রান্সের একটি প্রদেশ হিসেবে গণ্য হত। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফ্রান্সের পরাজয়ের পর আলজিরিয়ার স্বাধীনতা স্পৃহা বেড়ে যায়। ফরাসিদের দ্বারা অনুষ্ঠিত আলজিরিয়ার সাধারণ নির্বাচনে ফরাসি-বিরোধী গোষ্ঠী সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করলে সেই নির্বাচন বাতিল হয়ে যায়। এর ফলে আলজিরিয়ায় সশস্ত্র গণআন্দোলনের সূচনা হয়। পরিশেষে ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে গণভোটের দ্বারা আলজিরিয়ার স্বাধীনতা স্বীকৃত হয়।
মরক্কো
ফ্রান্স ও স্পেনের যৌথ নিয়ন্ত্রণে ছিল মরক্কো দেশ। মরক্কোর সুলতান মহম্মদ ও মরক্কোর রাজনৈতিক দলগুলি ফ্রান্সের কাছে স্বাধীনতা দাবি করে। কিন্তু ফ্রান্স সেই দাবিকে আগ্রাহ্য করে কঠোর দমননীতির আশ্রয় নেয়। ফলে সেখানে উপজাতি বিদ্রোহের সূচনা হলে ফ্রান্স বিপদ বুঝতে পেরে আপস মীমাংসায় রাজি হয়। ফ্রান্স ও স্পেন ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের ৫ এপ্রিল মরক্কোর স্বাধীন স্বীকৃতি দানে বাধ্য হয়।
উপসংহার
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে গণচেতনায় সমৃদ্ধ এশিয়া ও আফ্রিকায় পরাধীন দেশগুলি তাদের মুক্তি কামনায় মেতে ওঠে। এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলিতে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের যে জোয়ার এসেছিল তাতে সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসী নীতি বাধা পেয়েছিল। দিকে দিকে শুধু মুক্তি-মুক্তি-মুক্তি, এশিয়া ও আফ্রিকার মুক্তিপাগল জনগণ যে রক্তঝরা সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছিল তার মূল্য ইতিহাসের পাতায় চিরকাল লেখা থাকবে।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .