বিভিন্ন ধরনের বৃষ্টিপাত
পৃথিবীর অধিকাংশ বৃষ্টিপাত ঊর্ধ্বগামী আর্দ্র বাতাস প্রসারিত হয়ে শীতল হওয়ার ফলে সংঘটিত হয়। বৃষ্টিপাতকে সাধারণত তিন ভাগে ভাগ করা যায়, যথা : (ক) পরিচলন বৃষ্টি, (খ) শৈলোৎক্ষেপ বৃষ্টি এবং (গ) ঘূর্ণবাত বৃষ্টি।
■ [ক] পরিচলন বৃষ্টি (Convectional Rain)
সাধারণ বায়ুর তুলনায় জলীয়বাষ্প হালকা বলে জলীয় বাষ্পপূর্ণ বায়ু সোজা উপর দিকে উঠে যায় এবং প্রসারিত ও শীতল হয়ে ঐ স্থানেই বৃষ্টিপাত ঘটায়। এই রকম বৃষ্টিপাতকে পরিচলন বৃষ্টি বলে।
• সংজ্ঞা
ঊর্ধ্বগামী আর্দ্রবায়ু উপরের শীতল বায়ুর সংস্পর্শে এসে ঠাণ্ডা ও ঘনীভূত হয়ে প্রথমে মেঘ ও পরে বৃষ্টিরূপে পৃথিবীপৃষ্ঠে ঝরে পড়ে। এই রকম বৃষ্টিপাতকে পরিচলন বৃষ্টিপাত বলা হয়।
• উদাহরণ
নিরক্ষীয় অঞ্চলের (যেমন: মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর প্রভৃতি) বায়ুমণ্ডলে জলীয়বাষ্পের পরিমাণ বেশি থাকায় এই অঞ্চলে সারা বছর ধরেই পরিচলন বৃষ্টিপাত হতে দেখা যায়।
পরিচলন বৃষ্টিপাতের কারণ
পরিচলন বৃষ্টিপাতের জন্য : (ক) বায়ুমণ্ডলে যথেষ্ট ঊষ্ণতা এবং (খ) এই উষ্ণতার সাহায্যে
বাষ্পীভূত হওয়ার জন্য প্রচুর জলভাগের প্রয়োজন। পৃথিবীর নিরক্ষীয় অঞ্চলে পরিচলন বৃষ্টিপাত হওয়ার এই দুটি প্রধান শর্তই ভালোভাবে পূরণ হয়, তাই নিরক্ষীয় অঞ্চলে পরিচলন বৃষ্টিপাত বেশি হয়, কারণ :
(১) নিরক্ষীয় অঞ্চলে স্থলভাগের তুলনায় জলভাগের বিস্তৃতি তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি এবং এই অঞ্চলে সারাবছর ধরে প্রায় লম্বভাবে সূর্যকিরণ পড়ার ফলে এখানে বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতাও বেশি। প্রচণ্ড উত্তাপের জন্য নিরক্ষীয় অঞ্চলের সমুদ্রের বিপুল জলরাশি বাষ্পীভূত হয়ে হাল্কা হওয়ার জন্য দ্রুত ঊর্ধ্বগামী হয়। উপরের বায়ুমণ্ডলের প্রবল শৈত্যের সংস্পর্শে এলে বাষ্পীভূত ঐ আর্দ্রবায়ু আর জলীয়বাষ্প ধরে রাখতে পারে না এবং তখন তা পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তির প্রভাবে বৃষ্টিরূপে ঝড়ে পড়ে। কাজেই বিশেষ অনুকূল পরিবেশের জন্যই নিরক্ষীয় অঞ্চলে পরিচলন বৃষ্টিপাত পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চল থেকে বেশি হয়।
(২) নিরক্ষীয় অঞ্চলের বায়ুমণ্ডলে সারাবছর ধরেই জলীয়বাষ্পের পরিমাণ বেশি থাকায় এই অঞ্চলে সারাবছর ধরে প্রায় প্রতিদিনই পরিচলন বৃষ্টিপাত হয়। প্রধানত বিকেলের দিকে বজ্রবিদ্যুৎসহ প্রবল বৃষ্টিপাত হল পরিচলন বৃষ্টিপাতের প্রধান বৈশিষ্ট্য।
এছাড়া নাতিশীতোষ্ণ মণ্ডলে গ্রীষ্মকালের শুরুতে এবং ভারতীয় উপমহাদেশে সাধারণত শরৎকালে পরিচলন বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে।
■ [খ] শৈলোৎক্ষেপ বৃষ্টি (Relief Rainfall)
জলীয় বাষ্পপূর্ণ বায়ু যদি কোনো পাহাড়ের দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়, তবে ঐ বায়ু আরও উপরে উঠে যেতে থাকে। পাহাড়ের উঁচু অংশ যদি বরফাবৃত থাকে তবে উপরে ওঠা ঐ বায়ু বরফের সংস্পর্শে এসে, অথবা উঁচুতে ওঠার ফলে এমনিতেই শীতল হয়ে ঐ পর্বতের বায়ুমুখী ঢাল বা প্রতিবাত ঢালে যে বৃষ্টিপাত ঘটায়, তাকে শৈলোৎক্ষেপ বৃষ্টি বলে।
বৃষ্টিচ্ছায় অঞ্চল (Rainshadow Area)
আর্দ্রবায়ু কোনো পাহাড়ে বাধা পেয়ে বায়ুমুখী ঢাল বা প্রতিবাতঢালে বৃষ্টিপাত করার পর তাতে আর জলীয়বাষ্প থাকে না। জলীয়বাষ্পহীন ঐ শুকনো বাতাস পাহাড় অতিক্রম করে পাহাড়ের অপর দিকে (অনুবাত ঢালে) গেলে সেখানে আর বৃষ্টিপাত হয় না। পাহাড়ের অপর দিকের ঐ বর্ষণ বঞ্চিত প্রায় বৃষ্টিহীন স্থানকে “বৃষ্টিচ্ছায় অঞ্চল”বলে।
● উদাহরণ
বঙ্গোপসাগর থেকে ছুটে আসা জলীয়বাষ্পপূর্ণ আর্দ্র বায়ু বাংলাদেশের উপর দিয়ে এসে গাড়ো-খাসি-জয়ন্তিয়া পাহাড়ে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে ঐসব পর্বতের বায়ুমুখী প্রতিবাত ঢালে অবস্থিত মেঘালয় রাজ্যের চেরাপুঞ্জি-মৌসিনরাম অঞ্চলে প্রবল শৈলোৎক্ষেপ বৃষ্টিপাত ঘটায়।
মেঘালয়ের রাজধানী শিলং এইসব পর্বতের অনুবাত ঢালে অবস্থিত হওয়ায় বৃষ্টিচ্ছায় অঞ্চলের মধ্যে পড়েছে, তাই এখানে বার্ষিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ খুবই কম।
■ [গ] ঘূর্ণবাত বৃষ্টি (Cyclonic Rainfall)
জলীয় বাষ্পপূর্ণ বায়ু ঘূর্ণবাতের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত নিম্নচাপের দ্বারা আকৃষ্ট হয়ে উপরে উঠে শীতল হয়ে যে বৃষ্টিপাত ঘটায়, তাকে ঘূর্ণবাত বৃষ্টি বলে। কোনও স্থানে প্রবল নিম্নচাপ কেন্দ্রের সৃষ্টি হলে, চারদিক থেকে ছুটে আসা শুকনো, ঠাণ্ডা ও ভারী বাতাসের উপর জলীয় বাষ্পপূর্ণ গরম বাতাস উঠে যাওয়ার জন্যই ঘূর্ণবাত বৃষ্টিপাতের সৃষ্টি হয়। সাধারণত এই জাতীয় বৃষ্টিপাত দীর্ঘ সময় ধরে ঝিরঝির করে পড়ে।
ঘূর্ণবাত বৃষ্টিপাতের কারণ
প্রচণ্ড উষ্ণতার ফলে, কোনো স্বল্পপরিসর স্থানে প্রবল নিম্নচাপের সৃষ্টি হলে ঐ একই নিম্নচাপ কেন্দ্রের দিকে জলভাগের উপর থেকে জলীয়বাষ্পপূর্ণ গরম বায়ু এবং স্থলভাগের উপর থেকে ঠাণ্ডা ও শুকনো বায়ু ভূমির প্রায় সমান্তরালভাবে ছুটে আসে।
জলভাগের উপর দিয়ে আসে বলে গরম বাতাসে প্রচুর জলীয়বাষ্প থাকে এবং গরম বাতাস ঠাণ্ডা বাতাসের চেয়ে হাল্কা হওয়ায় তা ঠাণ্ডা বাতাসের উপরে উঠতে বাধ্য হয়। ঠাণ্ডা বাতাস উপরে উঠলে গরম বায়ুর জলীয়বাষ্প সহজেই ঠাণ্ডা হয়ে দ্রুত শিশিরাঙ্কে পৌঁছে যায় এবং মেঘের সৃষ্টি করে। আরও ঠাণ্ডায় ঐ মেঘ ঘনীভূত হয়ে বৃষ্টিপাত ঘটায়। এই বৃষ্টিপাত প্রধানত ঘূর্ণবাতের প্রভাবে হয়, তাই এই বৃষ্টিপাতকে ঘূর্ণবাত বৃষ্টি বা সীমান্তবৃষ্টি বলে।
ক্রান্তীয় অঞ্চলের গ্রীষ্মমণ্ডলে প্রবল নিম্নচাপের সৃষ্টি হলে চারপাশের উচ্চচাপ অঞ্চল থেকে শীতল ও ভারী বাতাস ঐ নিম্নচাপ কেন্দ্রের দিকে ছুটে আসে এবং ঘুরতে ঘুরতে নিম্নচাপ কেন্দ্রের দিকে আসার সময় প্রবল বেগে উপরে উঠে উপরের শীতলবায়ুর সংস্পর্শে এসে শীতল ও ঘনীভূত হয়ে পরিচলন বৃষ্টিপাত ঘটায়। এই ধরনের বৃষ্টিপাতকে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ঘূর্ণবাত বৃষ্টিপাত বলে।
নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে উষ্ণ ও শীতল বায়ু পরস্পরের বিপরীত দিকে প্রবাহিত হয়। কিন্তু উষ্ণবায়ু হালকা বলে ধীরে ধীরে শীতল বায়ুর উপর উঠে আসে এবং উষ্ণবায়ুর মধ্যস্থিত জলীয় বাষ্প শীতল ও ঘনীভূত হয়ে যে বৃষ্টিপাত ঘটায় তাকে নাতিশীতোষ্ণ মণ্ডলীয় ঘূর্ণবাত বৃষ্টি বলে।
ঘূর্ণবাত বৃষ্টিপাতের উদাহরণ
ভারতে কালবৈশাখী ঝড়ের ফলে যে বৃষ্টিপাত হয় তা গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ঘূর্ণবাত বৃষ্টিপাতের একটি উদাহরণ। নিম্নচাপের ফলে সৃষ্টি হওয়া এই বৃষ্টি সাধারণত দীর্ঘ সময় ধরে ঝির ঝির করে পড়ে। দক্ষিণ ও মধ্য ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলে শরৎ ও হেমন্তকালে মাঝে মাঝে নাতিশীতোষ্ণ ঘূর্ণবাত বৃষ্টি হয়ে থাকে।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .