দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণ
সূচনা
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ভার্সাই-এর শান্তি সম্মেলন যুদ্ধের বিভীষিকা ও আতঙ্কের হাত থেকে বিশ্ববাসীকে শান্তির আশ্বাস দিয়েছিল। কিন্তু এত স্বল্প সময়ের ব্যবধানে আর একটি যুদ্ধ বিশ্বের শান্তিকামী মানুষের মনকে আশাহত করেছিল। ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের ১ সেপ্টেম্বর বিশ্বের বৃহৎ শক্তিবর্গ আবার ধ্বংসের মারণযজ্ঞে ঝাঁপিয়ে পড়ল, এই ঘটনার জন্য একাধিক কারণ দায়ী ছিল।
ভার্সাই সন্ধির অসারতা
অনেকেই বলেন যে, ভার্সাই সন্ধির মধ্যেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বীজ নিহিত ছিল। জার্মানি ভার্সাই সন্ধিকে মেনে নিতে পারেনি। মিত্রশক্তি জার্মানির ওপর একতরফাভাবে এই সন্ধি চাপিয়ে দেয়। এই সন্ধির শর্ত অনুযায়ী জার্মানির ওপর এক বিশাল অঙ্কের ক্ষতি-পূরণের বোঝা চাপানো হয়। ফলে জার্মানি এই সন্ধিকে একটি জবরদস্তিমূলক সন্ধি বলে মনে করত এবং এই সন্ধিকে ধ্বংস করার প্রচেষ্টা চালাতে থাকে। এর ফলে ইঙ্গ-ফরাসি শক্তির সঙ্গে জার্মানির বিরোধ অনিবার্য হয়ে ওঠে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়।
হিটলারের আগ্রাসন নীতি
হিটলারের পাশবিক ও নগ্ন আগ্রাসন নীতি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য দায়ী ছিল। হিটলার সমগ্র ইউরোপে তাঁর নাতসি দলের আধিপত্যকে যেভাবে প্রতিষ্ঠা করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন তা তাঁর নগ্নতা ও ধূর্ত কুটনীতির পরিচায়ক। তিনি চেকোশ্লাভিয়া অধিকার, রুশ-জার্মান অনাক্রমণ চুক্তি দ্বারা জার্মানবিরোধী জোটকে পঙ্গু করে রাখা এবং ভার্সাই সন্ধিকে উপেক্ষা করে পোল্যান্ড আক্রমণ করার মাধ্যমে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে ডেকে এনেছিলেন।
ফ্যাসিবাদের উত্থান
ইটালিতে ফ্যাসিবাদের উত্থান এবং জাপানের সাম্রাজ্যবাদ ও যুদ্ধনীতি ইউরোপে যুদ্ধের বহ্নিশিখা জ্বালিয়ে দেয়। ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে জাপানের মাঞ্চুরিয়া আক্রমণ, ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে চিন আক্রমণ, অন্যদিকে ফ্যাসিস্ট ইটালির আবিসিনিয়া দখল, স্পেনের গৃহযুদ্ধে অংশগ্রহণ বিশ্বের শান্তিকে বিঘ্নিত করে। এইভাবে ইটালি ইউরোপে সন্ত্রাস ও যুদ্ধের বিভীষিকা ছড়িয়ে দেয়।
ইঙ্গ-ফ্রান্স তোষণ নীতি
কমিউনিস্ট রাশিয়ার এবং সাম্যবাদের প্রভাব থেকে ইউরোপকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে ফ্রান্স ও ব্রিটেনের জার্মানির প্রতি তোষণ নীতি যুদ্ধকে ত্বরান্বিত করে। জার্মানি এই সুযোগে সমরাস্ত্রে সজ্জিত হয়ে, অস্ট্রিয়ার ওপর আধিপত্য স্থাপন, লোকার্নো চুক্তি ভাঙা প্রভৃতি কার্যকলাপ চালিয়ে যেতে থাকে। হিটলারও মনে করতে থাকেন যে তাঁর আগ্রাসী নীতিতে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স কোনো বাধার সৃষ্টি করবে না। সেই উদ্দেশ্যে হিটলার ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের ১ সেপ্টেম্বর পোল্যান্ড আক্রমণ করলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।
সাম্রাজ্যবাদী নীতির প্রভাব
সাম্রাজ্যবাদী ও ঔপনিবেশিক নীতি যুদ্ধের বাতাবরণ সৃষ্টি করে। এদিক থেকে ইংল্যান্ড ছিল সবার শীর্ষে। বিশ্বের বেশির ভাগ দেশ তখন ইংল্যান্ডের দখলে। কিন্তু অবাধ বাণিজ্য নীতির ফলে জার্মানি, ইটালি, জাপান প্রভৃতি দেশও অসম প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে। তারা প্রত্যেকেই ঔপনিবেশিক বাজার খুঁজতে থাকে। এজন্য সবাই নিজ নিজ দেশের আমদানি কমিয়ে রপ্তানি বাড়াবার চেষ্টা করে। কিন্তু ইংল্যান্ডের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় জার্মানি, জাপান, ইটালি এঁটে উঠতে পারেনি। ফলে ইংল্যান্ডের বর্ধিত শুল্ক নীতি তারা মেনে নিতে বাধ্য হয়। এই বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা যুদ্ধের আবহাওয়া তৈরি করে।
জাতিসংঘের ব্যর্থতা
আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষার প্রতিশ্রুতি নিয়ে গঠিত হলেও বিশ্বের বৃহৎ দেশগুলির সদস্যপদ গ্রহণ না করা এবং নিজ নিজ স্বার্থসিদ্ধিতে তৎপর থাকা দেশগুলি জাতিসংঘের অস্তিত্বকে হীনবল করে দেয়। অন্যদিকে জাতিসংঘের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যকে উপেক্ষা করে শক্তিশালী দেশগুলির আক্রমণ নীতি যুদ্ধকে অনিবার্য করে তোলে।
উপসংহার
উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের স্বীকার করতে হয় যে, বৃহৎ ও শক্তিশালী দেশগুলির মধ্যে শান্তিরক্ষার আন্তরিক ইচ্ছা না থাকলে শান্তি প্রচেষ্টা ব্যাহত হতে বাধ্য। সমকালীন পরিস্থিতি, ভার্সাই সন্ধিতে জার্মানির প্রতি অবিচার, সাম্রাজ্যবাদী নীতি যুদ্ধের উন্মাদনা সৃষ্টি করে। সবশেষে বলা যায় যে, জাতিসংঘের শান্তি প্রচেষ্টা বিশ্বকে যুদ্ধের বাতাবরণ থেকে মুক্ত করতে ব্যর্থ হয়।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .