সাহিত্যিক উপাদানের গুরুত্ব
আর্যদের সময় থেকে সাধারণত ভারতের ইতিহাসে উপাদানের প্রাচুর্য লক্ষ করা যায়। সাহিত্যিক উপাদানকে মূলত দুটি ভাগে ভাগ করা যায়— দেশীয় সাহিত্য ও বিদেশি পর্যটকদের বিবরণ।
দেশীয় সাহিত্য
প্রাচীন ভারতে বিভিন্ন পর্যায়ে একাধিক গ্রন্থ রচিত হয়। এগুলিকে দেশীয় সাহিত্য বলা হয়। দেশীয় সাহিত্য বিষয়ভিত্তিকভাবে দুই প্রকার—ধর্মীয় সাহিত্য ও ধর্মনিরপেক্ষ সাহিত্য।
ধর্মীয় সাহিত্য
হিন্দুধর্মকে কেন্দ্র করে প্রাচীন ভারতে যে সকল গ্রন্থ রচিত হয়েছিল। তার মধ্যে বেদ, পুরাণ, উপনিষদ, রামায়ণ, মহাভারত, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক, স্মৃতিশাস্ত্র প্রভৃতি প্রধান। বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম বিষয়ক গ্রন্থ ত্রিপটক জাতক, মহাবংশ, দীপবংশ, জৈনকল্পসূত্র, ভাগবতীসূত্র ইত্যাদি গ্রন্থও ধর্মগ্রন্থের অন্তর্গত। এই গ্রন্থগুলি থেকে তৎকালীন ভারতের ধর্মীয় ব্যবস্থা সমাজ, অর্থনৈতিক বিন্যাস ও সংস্কৃতি সম্পর্কে ধারণালাভ করা যায়।
ধর্মনিরপেক্ষ সাহিত্য
ধর্মনিরপেক্ষ সাহিত্যগুলি বিভিন্ন উদ্দেশ্যে রচিত হয়েছিল। অনেকগুলি রচনা জীবনী আকারে পাওয়া যায়। এর মধ্যে বানভট্টের ‘হর্ষচরিত’, অশ্বঘোষের ‘বুদ্ধচরিত’, সন্ধ্যাকর নন্দীর ‘রামচরিত’, বিল্হনের ‘বিক্রমাঙ্কদেব চরিত’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
এই গ্রন্থগুলি থেকে হর্ষবর্ধন, রামপাল, দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত প্রমুখ শাসকের শাসন কাল সম্পর্কে জানা জায়।
ধর্মনিরপেক্ষ সাহিত্যের একটি বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে বিভিন্ন পণ্ডিতের লেখা অর্থনীতি, রাষ্ট্রনীতি, আইন, ব্যকরণ, বিজ্ঞান, প্রভৃতি বিষয়ক গ্রন্থ। এগুলির মধ্যে কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র, পানিনির ‘অষ্টাধ্যায়ী’, পতঞ্জলীর ‘মহাভাষ্য’, বিশাখাদত্তের ‘মুদ্রারাক্ষস’ নাটক, নাগার্জুনের ‘মাধ্যমিকা সংহিতা’, শুদ্রকের রচিত গ্রন্থ প্রভৃতি উল্লেখ যোগ্য। আঞ্চলির ক্ষেত্রেও বেশ কিছু গ্রন্থ রচিত হয়। কল্হনের ‘রাজতরঙ্গিনী’ থেকে কাশ্মীরের ইতিহাস, রাজশেখর রচিত ‘প্রবন্ধ কোশ’ প্রভৃতি থেকে গুজরাটের ইতিহাস জানা জায়।
বৈদেশিক বিররণ
প্রাচীনভারতে বিভিন্ন সময়ে আসা বিদেশি সাহিত্যিক ও পর্যটকদের বিবরণী থেকেও ভারত সম্পর্কে অনেক তথ্য জানা যায়। মেগাস্থিনিস রচিত ‘ইন্ডিকা’, প্লিনি রচিত’ প্রাকৃতিক ইতিহাস’, টলেমি রচিত ‘ভূগোল’, প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও কুইন্টাস, কার্টিয়াস, প্লুটার্ক প্রমুখের রচনা, জনৈক অজ্ঞাত মিশরীয় নাবিকের লেখা ‘পেরিপ্লাস অফ্ দি এরিথ্রিয়ান সী’ নামক গ্রন্থটি থেকে ভারতের ভৌগোলিক অবস্থা, ইতিহাস, বন্দর ও বাণিজ্য, বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক প্রভৃতি বিষয়ে জানা যায়। চিনা পর্যটক ফা-হিয়েনের ‘ফু-কিউ-কি ও হিউয়েন সাঙ রচিত ‘সি-ইউ-কি’ গ্রন্থ দুটি থেকে ভারতে বৌদ্ধ ধর্ম বিকাশের পাশাপাশি গুপ্তযুগ ও হর্ষবর্ধনের শাসনকাল সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য জানা যায়।
সীমাবদ্ধতা
প্রাচীনভারতীয় গ্রন্থগুলি কখনোই ঐতিহাসিক গ্রন্থরূপে রচিত হয়নি। তাছাড়া ধর্মীয় সাহিত্য ও ধর্মনিরপেক্ষ সাহিত্য অধিকাংশ ক্ষেত্রে এমন অনেক বর্ণনা দেয়। যা বিশ্বাস যোগ্য নয়। এমনকি বৈদেশিক বিবরণীতে এমন অনেক উল্লেখ পাওয়া যায় যার সঙ্গে ভারতীয় সমাজ বা সংস্কৃতির কোনো সম্পর্ক ছিল না বলেই প্রমাণিত হয়েছে। তাছাড়া অনেক রচনা সভাকবিদের দ্বারা রচিত হওয়ায় বিভিন্ন শাসকের শাসনকালের প্রকৃত চিত্র না পাওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। এই সমস্ত কারণে লিখিত উপাদানগুলিকে যত্নসহকারে বিশ্লেষণ করা হয় এবং অন্যান্য উপাদানগুলির নিরীখে সভ্যতা যাচাই করা হয়। এরূপ সীমাবদ্ধতা স্বত্ত্বেও সাহিত্যিক উপাদানের গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .