পশ্চিমবঙ্গের সমভূমি অঞ্চল
উত্তরের পার্বত্য অঞ্চল এবং পশ্চিমের মালভূমি অঞ্চলকে বাদ দিলে পশ্চিমবঙ্গের অধিকাংশ স্থানই সমভূমি। পশ্চিমবঙ্গের এই অঞ্চলটি নদীবাহিত পলিসঞ্চয়ের ফলে গড়ে উঠেছে। পশ্চিমবঙ্গের সমগ্র সমভূমি অঞ্চলকে ভূ-প্রকৃতিগত পার্থক্যের জন্য নিম্নলিখিত ভাগে ভাগ করা যায়, যেমন :
(১) তরাই ও ডুয়ার্স অঞ্চল
পশ্চিমবঙ্গের পার্বত্য অঞ্চলের দক্ষিণে, অর্থাৎ দার্জিলিং জেলার শিলিগুড়ি মহকুমা এবং জলপাইগুড়ি জেলার উত্তর ও পূর্ব অংশে এই অঞ্চলটি বিস্তৃত।
এই অঞ্চলটি উত্তর থেকে দক্ষিণে ঢালু হয়ে গিয়েছে। অসংখ্য নদীখাত তরাই অঞ্চলটিকে বিভিন্ন সমান্তরাল অংশে বিভক্ত করেছে। এই অঞ্চলের অধিবাসীদের কাছে তিস্তা নদীর ডানদিকের অংশ তরাই এবং বাঁদিকের অংশ ডুয়ার্স নামে পরিচিত। তরাইয়ের চেঙ্গমারি, লঙ্কাপাড়া হাট, জয়ন্তী প্রভৃতি অঞ্চলে ভুটানের ডুয়ার্স পর্বতমালার অংশ দেখা যায়।
(২) উত্তরের সমভূমি অঞ্চল
পশ্চিমবঙ্গের উত্তরের পার্বত্য অঞ্চলের দক্ষিণে, তরাই ও গঙ্গার মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত মালদহ, উত্তর ও দক্ষিণ-দিনাজপুর এবং কোচবিহার, এই চারটি জেলা উত্তরের সমভূমি অঞ্চলের অন্তর্গত হয়েছে। তিস্তা, তোর্ষা, মহানন্দা প্রভৃতি নদীর পলি জমা হয়ে উত্তরের সমভূমি অঞ্চলটি গড়ে উঠেছে। মোটামুটি ভাবে সমতল হলেও মাঝে মাঝে এখানে-সেখানে খালবিল এবং উঁচু-নীচু জমি চোখে পড়ে। এখানে কোনো কোনো স্থানে ৩০মিটার পর্যন্ত উঁচু ঢিবি দেখা যায়। ভূপ্রকৃতিগতভাবে উত্তরের সমভূমি অঞ্চলকে ৩টি অংশে ভাগ করা যায়, এরা হল-
(ক) তাল
কালিন্দী নদীর পূর্ব ভাগে অবস্থিত কোচবিহার জেলার দক্ষিণতম অংশ এবং সমগ্র উত্তর ও দক্ষিণ-দিনাজপুর জেলা তাল সমভূমি নামে পরিচিত। ভূ-প্রকৃতিগতভাবে এটি একটি নীচু প্লাবনভূমি।
(খ) বরেন্দ্রভূমি
মহানন্দা নদীর বাঁ তীরে অবস্থিত মালদহ ও দক্ষিণ-দিনাজপুর জেলার কিছুটা ঢেউখেলানোও প্রাচীন পলিগঠিত পূর্বাংশ বরেন্দ্রভূমি নামে পরিচিত। বরেন্দ্রভূমির মৃত্তিকা লাল রঙের, শক্ত, অনুর্বর ও ল্যাটারাইট জাতীয়।
(গ) দিয়ারা
মালদহ জেলার কালিন্দী নদীর দক্ষিণাংশের নবীন পলিগঠিত ভূমি দিয়ারা নামে পরিচিত। এই অঞ্চলটি খুব উর্বর ও ঘনবসতিপূর্ণ।
(৩) রাঢ় অঞ্চল
পশ্চিমের মালভূমির পূর্ব সীমা থেকে ভাগীরথী-হুগলি নদীর পশ্চিম তীর পর্যন্ত বিস্তৃত, সামান্য ঢেউখেলানো ও পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে ঢালু হয়ে যাওয়া বিস্তীর্ণ সমভূমি অঞ্চলটি রাঢ সমভূমিনামে পরিচিত। পুরানো পলিমাটি দিয়ে গঠিত এই অঞ্চলটির মাটির রঙ লাল। অজয়, দামোদর, ময়ূরাক্ষী, শিলাবতী, কংসাবতী, বক্রেশ্বর প্রভৃতি হল রাঢ় অঞ্চলের প্রধান নদী। এই অঞ্চলটি কৃষিকাজে অত্যন্ত উন্নত।
(৪) উপকূলের বালুকাময় সমভূমি
মেদিনীপুর জেলার উপকূলভাগ এই অঞ্চলের অন্তর্গত। সর্বদক্ষিণের উপকূলবর্তী তটভূমি বালুকাময়। তটভূমির ঢাল খুবই কম। এখানের বিভিন্ন স্থানে বালিয়াড়ি দেখা যায়। তটভূমির উত্তর দিকের বালিয়াড়িগুলি সমুদ্র উপকূলের সমান্তরালভাবে পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তৃত। দুটি বালিয়াড়ির মাঝের নীচু অংশে জলাভূমি দেখা যায়।
(৫) গঙ্গার বদ্বীপ অঞ্চল
ভাগীরথী-হুগলি নদীর পূর্ব তীর থেকে পূর্ব দিকে বাংলাদেশের সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত, গঙ্গা বা পদ্মা ও ভাগীরথী-হুগলি নদীর মধ্যবর্তী স্থানটি গঙ্গার বদ্বীপ অঞ্চল নামে পরিচিত। এই অঞ্চলের উত্তরে পদ্মা নদী এবং দক্ষিণে সুন্দরবন অঞ্চল অবস্থিত। 1
সমগ্র অঞ্চলটি সমতল কিন্তু উত্তর থেকে দক্ষিণে ক্রমশ ঢালু হয়ে গিয়েছে। গঙ্গা বা পদ্মা, ময়ূরাক্ষী, অজয়, দামোদর, দ্বারকেশ্বর, রূপনারায়ণ, কাঁসাই প্রভৃতি নদনদী বাহিত পলি সঞ্চয়ের ফলে কালক্রমে সমুদ্রবক্ষ থেকে এই নতুন ভূ-ভাগ বা বদ্বীপের সৃষ্টি হয়েছে। ভাগীরথীর জল কমে যাওয়ায় পলির পরিমাণও কমে গেছে এবং পলি সঞ্চয়ের দ্বারা এখানে আর আগেকার মতো বদ্বীপ গঠন সম্ভব হচ্ছে না। পলির বয়েস অনুসারে গাঙ্গেয় বদ্বীপ অঞ্চলটিকে দু ভাগে ভাগ করা যায়, যথা : (ক) মৃতপ্রায় বদ্বীপ এবং (খ) পরিণত বদ্বীপ। গাঙ্গেয় বদ্বীপ অঞ্চলের প্রধান নদী হল : জলঙ্গী, ভৈরব, মাথাভাঙা, চূর্ণী, ইছামতী প্রভৃতি।
(৬) সুন্দরবন অঞ্চল
দক্ষিণ ২৪ পরগণার দক্ষিণাংশ এই অঞ্চলের অন্তর্গত। এই অঞ্চলটি পুরোপুরিভাবে সক্রিয় বদ্বীপ অঞ্চলের অন্তর্গত। তাই এখানে বদ্বীপ গঠনের কাজ এখনও চলছে। সুন্দরবনের নদীগর্ভ ছাড়া সমস্ত অংশই সমতল। সমুদ্রতল থেকে এর গড় উচ্চতা মাত্র ৩-৪ মিটার। তাই এর অনেকটাই সমুদ্রজলের জোয়ারে ঢেকে যায়।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .