Register Now

Login

Lost Password

Lost your password? Please enter your email address. You will receive a link and will create a new password via email.

Captcha Click on image to update the captcha .

Add question

জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবদান আলোচনা করো।

জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবদান

ভূমিকা 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন কবি, শিক্ষাবিদ, নাট্যকার, সংগীত শিল্পী, দার্শনিক, সাহিত্যিক ইত্যাদি এক কথায় সর্বযজ্ঞের পুরোহিত। তাঁর জীবনদর্শনের বীজ শিক্ষাদর্শনে রোপিত আছে। তাঁর শিক্ষাদর্শনের বীজ জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনের পরিসরে অঙ্কুরিত হয়েছে, বিকশিত হয়েছে, এর ফলে তিনি হয়েছেন কালজয়ী।

জাতীয় শিক্ষার ধারণা

ঊনবিংশ শতাব্দীর নবজাগরণের অঙ্গনে ভারতবাসীরা বিশেষভাবে অনুধাবন করেছিলেন যে, ভারতীয় রীতিনীতি, বিশ্বাস, আদর্শ, ধর্মবিরোধী বিদেশি শিক্ষা মূলত জীবনের সঙ্গে সংযোগবিহীন। তাই শিক্ষা সংস্কারের জন্য জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ তৎকালীন ভারতবাসীর দুঃখ-দুর্দশা, দ্বিচারিতা অনুভব করেছিলেন। ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ওপর সাম্রাজ্যবাদীদের নিষ্পেষণ, জীবন বিচ্ছিন্ন শিক্ষার কার্যক্রম, তাঁর মনোজগতে কুঠারাঘাত করেছিল। তিনি কবিতা, নাটক, উপন্যাস, সংগীত, প্রবন্ধ প্রভৃতির মাধ্যমে স্বদেশপ্রীতি ও জাতীয় শিক্ষার ধ্যানধারণা দেশপ্রেমিক ভারতীয়দের মনে গেঁথে দিয়েছিলেন।

ইংরেজ প্রবর্তিত শিক্ষার সমালোচনা ও রবীন্দ্রনাথের জাতীয়তাবাদ

জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের অন্যতম পুরোহিত রবীন্দ্রনাথ ইংরেজ প্রবর্তিত কেরানি-গড়া শিক্ষানীতির অসারতা উপলব্ধি করেছিলেন। এ ছাড়াও তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে ওই শিক্ষানীতি ভারতের কৃষ্টি সংস্কৃতি-ঐতিহ্যের ধারা বহনে অক্ষম। এটি ইংরেজসত্তার অভিব্যক্তি মাত্র। গুরুদেব তাঁর ‘শিক্ষার হেরফের’ প্রবন্ধের মাধ্যমে ইংরেজ প্রবর্তিত শিক্ষার সঙ্গে আমাদের জাতীয় শিক্ষা চেতনার অসামঞ্জস্যতার দিকটি তুলে ধরেছেন। তিনি জাতীয় চেতনা বিকাশের ক্ষেত্রে জাতীয় শিক্ষার উত্তরণ ঘটিয়ে তাকে উপজীব্য করার পরামর্শ দিয়েছেন।

শিক্ষাগুরু রবীন্দ্রনাথ লর্ড মেকলের (Lord Macaulay) চুইয়ে পড়া নীতি’র (Downword filtration theory) তীব্র নিন্দা করেছেন | এই নীতিতে বলা হয়েছে, সমাজের উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষগুলিকে শিক্ষিত করে তুলতে পারলে তার ফলশ্রুতি হিসেবে তাদের থেকে সাধারণ জনগণের মধ্যে শিক্ষা ক্রমশ চুঁইয়ে পড়বে। মেকলের মিনিট (Macaulay’s minutes) ভারতের শিক্ষা-সংস্কৃতি ঐতিহ্যে আঘাত হেনেছে। ভারতের শাশ্বত ধারা-বিচ্যুত এই পাশ্চাত্য শিক্ষানীতি ভারতীয়দের ইংরেজ প্রভুদের কাছে দাস বানাতে প্রয়াসী হয়েছে। তাই জাতীয়তাবাদের মহামন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে সমাজ প্রাজ্ঞ রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, “শিক্ষার অভিসিঞ্চনক্রিয়া সমাজের ওপরের স্তরকেই দুই-এক ইঞ্চি মাত্র ভিজিয়ে দেবে আর নীচের স্তর পরম্পরা নিত্য নীরস কাঠিন্যে সুদূর প্রসারিত মরুমাতাকে ক্ষীণ আবরণে ঢাকা দিয়ে রাখবে—এমন চিত্তঘাতী সুগভীর মূর্খতাকে কোনো সভ্য সমাজ অলসভাবে মেনে নেয়নি। ভারতবর্ষকে মানতে বাধ্য করেছে আমাদের যে নির্মম ভাগ্য তাকে শতবার ধিক্কার দিই।”

রবীন্দ্রনাথ ভারতবাসীকে ভয়শূন্য চিত্ত ও উন্নত শিরে জাতীয়তাবাদের মহামন্ত্রে দীক্ষিত হতে বলেছেন। তাই তিনি নিম্ন-মধ্য-উচ্চবিত্ত সকল ভারতবাসীকেই একই শিক্ষানীতির সাম্রজ্যের কখনে থাকতে পরামর্শ দিয়েছিলেন। তিনি তাঁর গৃহ পরিবেশ থেকেই জাতীয় চেতনার শক্তি অর্জন করেছিলেন। সমাজসচেতক রবীন্দ্রনাথের গৃহ পরিবেশ ছিল জাতীয়তাবাদের আবহে পরিব্যাপ্ত। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে যে হিন্দুমেলা বসত সেই মেলায় দেশাত্মবোধক সংগীত ও দেশাত্মবোধক কবিতা পরিবেশন করা হত। এ ছাড়াও স্বাদেশিকতার বিবিধ উপকরণ সেখানে প্রদর্শিত হত। জাতীয় ভাবধারায় তদানীন্তন সামাজিক পরিবেশ সিক্ত হত। রবীন্দ্রনাথ অবহেলিত, নিপীড়িত, দুর্গত দেশবাসীর জন্য রচনা করেছিলেন বিবিধ প্রবন্ধ, কবিতা, উপন্যাস প্রভৃতি। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল দেশবাসী যাতে জাতীয় শিক্ষার দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে এবং নিজেদেরকে সমৃদ্ধ করে।

1905-1906 খ্রিস্টাব্দে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের প্রাণপুরুষ রবীন্দ্রনাথ জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনের পথপ্রদর্শক ছিলেন।

গণশিক্ষা

রবীন্দ্রনাথ উপলব্ধি করেছিলেন যে, ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশে গণশিক্ষাই মনের কালিমা, কুসংস্কার দূর করতে পারে, সংহতিপূর্ণ বিশ্বসংস্কৃতি গড়তে পারে। তাঁর মতে, গণনিরক্ষরতা জাতীয় উন্নয়নের পরিপন্থী ও অভিশাপ। গণশিক্ষাই জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনের অন্যতম হাতিয়ার। রবীন্দ্রনাথ গণশিক্ষাকে (Mass education) তুলে ধরতে শান্তিনিকেতনে শ্রীনিকেতন এবং লোকশিক্ষা সংসদ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

মাতৃভাষায় অনুরাগ

শিক্ষানীতির ধারা অনুযায়ী জাতীয় চেতনার উন্মেষ সাধনের জন্য মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদানের উল্লেখ আছে। নবজাগরণের অন্যতম পুরোহিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জাতীয় আন্দোলনকে দৃঢ় ভিতের ওপর প্রতিষ্ঠিত করতে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদানের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। ‘শিক্ষার বাহন’ প্রবন্ধে নিম্নস্তর থেকে উচ্চস্তর পর্যন্ত পঠনপাঠনে মাতৃভাষাকে অবলম্বন করার কথা ব্যক্ত করে গেছেন। গুরুদেব মাতৃভাষাকে মাতৃদুগ্ধময় করে জাতীয় চেতনার উন্মেষ মাঝে জীবন গড়ার মন্ত্র দিয়ে গেছেন ।

জাতীয়তাবাদ

রবীন্দ্রনাথ যখন তাঁর সৃষ্টির মধ্যগগনে বিরাজমান তখন আমাদের ভারতে চলছিল স্বাধীনতা সংগ্রাম | তিনি ‘শিক্ষা সংস্কার’, ‘শিক্ষা সমস্যা, ‘শিক্ষা বিধি’, ‘আশ্রমের রূপ ও বিকাশ’, ‘বিশ্বভারতী শিক্ষা ও সংস্কৃতি’ প্রভৃতি শিক্ষামূলক প্রবন্ধের মাধ্যমে মানুষ তৈরির (Man making) প্রয়াসে ব্রতী হয়েছেন। তিনি জাতীয়তাবাদে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে, জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনের মাধ্যমে জাতীয় শিক্ষাকে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন।

উপসংহার

রবীন্দ্রনাথ জাতীয় চেতনা প্রসার মাঝে জাতীয় শিক্ষার আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে যে বীজ বপন করেছিলেন, সে বীজ আন্দোলনের যাত্রাপথে প্রস্ফুটিত ও বিকশিত হয়েছিল। স্বাধীনতা সংগ্রামে গতি এনেছিল এবং কালের ইতিহাসে জয়যাত্রার ধ্বজা তুলে ধরেছিল। জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনের অন্যতম সাধক হিসেবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবদান চিরস্মরণীয়।

Leave a reply