জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনে ঋষি অরবিন্দের অবদান
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের আন্দোলনে তথা জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনে যে সমস্ত মনীষী জাতীয়তাবাদের মহান আদর্শ প্রচার করেছিলেন, মুক্তির বাণী শুনিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন ভারতের মুক্তি সংগ্রামের অগ্রদূত ঋষি অরবিন্দ।
সংক্ষিপ্ত জীবনী ও শিক্ষা
1872 খ্রিস্টাব্দের 15 আগষ্ট শিক্ষাব্রতী ঋষি অরবিন্দের জন্ম হয় কলকাতার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে। তাঁর পিতা হলেন কৃষ্ণধন ঘোষ এবং মাতা স্বর্ণলতা দেবী। পৈতৃক নিবাস হুগলি জেলার কোন্নগরে। তিনি পাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহণ করতে 1879 খ্রিস্টাব্দে বিদেশ যাত্রা করেন। 1892 খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডের কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ট্রাইপস ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর তিনি স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করে বরোদা কলেজে অধ্যাপনায় ব্রতী হন। দেশের মাটিতে এসে একদিকে তিনি যেমন প্রাচ্যের শিক্ষা, সংস্কৃতি, দর্শন প্রভৃতির সঙ্গে জড়িয়ে ভারতীয় জীবনের শাশ্বত ধারার সঙ্গে বিশেষভাবে পরিচিত হন, অপরদিকে বিদেশি শক্তির আন্দোলনে গণতন্ত্রের মৃত্যুধ্বনি বাজায় বিচলিত হন। ধর্ম-কর্ম-জাতীয়তাবাদের বেদিতে নিজেকে সঁপে তিনি রচনা করেন—’Life Divine’, ‘The synthesis of yoga’, ‘কর্মযোগিন’, গীতা-উপনিষদ-পুরাণ প্রভৃতি অবলম্বনে হৃদয়স্পর্শী গ্রন্থ।
জাতীয় শিক্ষা ভাবনা
অধ্যাপনা করার কালে ঋষি অরবিন্দ পরাধীন ভারতবর্ষকে শৃঙ্খলামুক্ত করতে যে মহান ব্রতের ডাক দিয়েছিলেন, সে ডাকে জাতিধর্মনির্বিশেষে সকল দেশপ্রেমীরা সাড়া দিয়েছিলেন। স্বাধীনতা সংগ্রামী অরবিন্দ বুঝতে পেরেছিলেন যে, জীবনের সঙ্গে সংযোগহীন বিদেশি শিক্ষার সংস্কারকল্পে জাতীয় শিক্ষা আন্দোলন একান্তই প্রয়োজন। তাঁর সেই বাসনাকে বাস্তবায়িত করতে মারাঠা বীর লোকমান্য তিলকের সঙ্গে যোগী অরবিন্দের মধ্যে যে নিখাদ যোগসূত্র রচিত হয়েছিল, সেই সূত্রই নবজাগরণের পথকে প্রশস্ত করেছিল। ঋষির যজ্ঞবেদি হতে নেমে এসে সেদিন ওই জ্যোতির্ময় মহাপুরুষ পরাধীন দেশের আকাশে, বাতাসে দেশাত্মবোধের নীতিতে জোয়ার এনেছিলেন। 1886 খ্রিস্টাব্দে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে সভাপতি করে জাতীয় মহাসভা প্রতিষ্ঠিত হয়। সে সময় ভারতের বড়োলাট লর্ড কার্জনের দুরভিসন্ধির খেলায় বাংলা দু-ভাগ হয়। 1905 খ্রিস্টাব্দের 16 অক্টোবর বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হলে সারা বাংলা উত্তাল হয়ে ওঠে।
“বন্দেমাতরম্’ নামে সংবাদপত্রের মাধ্যমে বৈপ্লবিক চিন্তাধারার উন্মেষ ঘটানো হয়, বিশেষ করে দেশের যুব সম্প্রদায়কে দৈহিক-মানসিক-আধ্যাত্মিক শক্তিতে বলীয়ান হওয়ার পথ নির্দেশ করা হয়। দার্শনিক ঋষি অরবিন্দ সেদিন অনুধাবন করেছিলেন যে, শিক্ষার্থীদের যথার্থভাবে উদ্বুদ্ধ করতে প্রয়োজন জাতীয় শিক্ষা। তাই তিনি এ পথেই হাঁটেন। ছাত্র-ছাত্রীরা ইংরেজ শাসক পরিচালিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ত্যাগ করেন। ‘জাতীয় শিক্ষা পরিষদ’ গঠিত হয়। 1906 খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে শ্রী অরবিন্দ অধ্যাপকের পদ ত্যাগ করে দেশমাতৃকার বেদিতে নির্মাল্য হিসেবে নিজেকে উৎসর্গ করে ‘জাতীয় শিক্ষা পরিষদ’-এর অধ্যক্ষের পদ গ্রহণ করেন এবং জাতীয় শিক্ষা সম্প্রসারণে ব্রতী হন।
1906 খ্রিস্টাব্দ থেকে 1910 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ‘বন্দেমাতরম্’ পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর প্রায় 100টি সম্পাদকীয়, 1909 খ্রিস্টাব্দ থেকে 1910 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে প্রকাশিত ‘ধর্ম ও কর্মযোগী’তে তাঁর রচনাগুলি, মন্টেগু-চেমসফোর্ড সংস্কার’ বিষয়ে তাঁর মতামত, বিভিন্ন দেশাত্মবোধক বক্তৃতা প্রভৃতি জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনের ধারায় জোয়ার এনেছিল। জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনের অংশীদার বিপ্লবী অরবিন্দের কলম হতে সেদিন বেরিয়ে এসেছিল— “The only true. education will be that which will be an instrument for the real working of the spirit is mind and body of the individual and the nation.”
এ সময় বাংলা ভাষায় প্রকাশিত দৈনিক স্বদেশি পত্রিকা ‘যুগান্তর’ শাসকের নির্দেশে বন্ধ হয়ে যায়। অগণিত স্বাধীনতা সংগ্রামী কারাবরণ করেন। অত্যাচার, অনাচার, শাসন, শোষণ সত্ত্বেও আন্দোলন থেমে থাকেনি বরং ভারতবাসীর জাতীয় চেতনা বাড়তে থাকে। আত্মত্যাগ ভারত জমিনে স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে দেখা দেয় এবং জাতীয় শিক্ষা আন্দোলন আরও শক্তিশালী হয়।
আন্দোলন চলাকালীন মাতৃভূমির অন্যতম সাধক বিপ্লবী অরবিন্দ 1908 খ্রিস্টাব্দের ও মে বোমা বিস্ফোরণে যুক্ত থাকার অভিযোগে কারাবরণ করেন। এতে সংগ্রামের অগ্নিস্ফুলিঙ্গে ঘৃতাহুতি ঘটে। যদিও এরপর আলিপুর সেশন কোর্টে বিচার শুরু হলে বিচারপতি Beachcroft সাহেবের রায়ে শ্রীঅরবিন্দ-সহ কয়েকজন মুক্তি পান। এরপর শ্রীঅরবিন্দ রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে আধ্যাত্মিক চিন্তায় মনোনিবেশ করেন এবং পণ্ডিচেরিতে (পুদুচেরি) আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন ।
উপসংহার
জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনের (National Education Movement) আঙিনায় স্বাধীনতা সংগ্রামী শ্রীঅরবিন্দের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে ।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .