জগৎ পরিবর্তনশীল। এই চিরপরিবর্তনশীল, সদা বিকাশমান জগতে ক্রমবর্ধমান চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে মানুষ তার চিন্তন-মননের জগতে পরিবর্তন এনে চলেছে। ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে অজানা-অচেনা পথের যাত্রী হয়ে মানুষ নতুন নতুন আবিষ্কারে মাতোয়ারা হয়ে নতুন নতুন দিগন্তের উন্মোচন ঘটিয়ে চলেছে। ফলে সমাজতত্ত্বের পরিবর্তন ঘটছে।
মানুষ শিক্ষার মাধ্যমে সমাজের সঙ্গে অভিযোজন করে চলেছে। তাই প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ John Dewey বলেছেন, “Education is adjustment and adjustment is education,” অর্থাৎ শিক্ষাই অভিযোজন এবং অভিযোজনই হল শিক্ষা। বর্তমানের শিশুকেন্দ্রিক (child centric) শিক্ষানীতিতে সমাজবিজ্ঞানের তাত্ত্বিক ধারণাগুলোর প্রয়োগিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। সমাজবিজ্ঞানের সঙ্গে শিক্ষার যে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, তার প্রধান প্রধান দিকগুলো হল—
শিক্ষা ও সমাজবিজ্ঞানের মধ্যে সম্পর্ক
1) সামাজিকীকরণ ও শিক্ষা
সমাজজীবনহীন বাক্তি কল্পনাতীত, আবার ব্যক্তি ছাড়া সমাজ অর্থহীন। শিক্ষার নানা প্রতিষ্ঠান, মাধ্যম, ঘটিয়ে চলেছে। শিক্ষাই ব্যক্তিকে করেছে সমাজ নিয়ন্ত্রণকারী এক প্রতিভূ। কৌশল প্রভৃতি ব্যক্তিকে সমাজের আচার-আচরণ, রীতিনীতি, আদর্শ, মূল্যবোধ প্রভৃতির সঙ্গে সংযোগ
2) সামাজিক প্রক্রিয়া ও শিক্ষার তাৎপর্য
সমাজবিজ্ঞানীদের অভিমত হল যে, সমাজ বিবর্তনের প্রক্রিয়া। সমাজ জীবনকে প্রক্রিয়াভিত্তিকভাবে প্রভাবিত করে থাকে; সমাজের অন্তর্গত প্রতিটি মানুষ প্রভাবিত হয়। সমাজ প্রক্রিয়ার (social process) গতীয় ধারণা শিক্ষাক্ষেত্রে গতি এনেছে। শিক্ষা যদি গতিধর্ম হারাত, শিক্ষা যদি জীবনভর ক্রিয়াশীল না হত, তাহলে সমাজের অভিব্যক্তির প্রকাশও গতি হারাত। তাই সমাজ নিয়ন্ত্রণকারী অন্যতম সংস্থা হল শিক্ষা।
3) সামাজিক সংগঠন ও শিক্ষা
সমাজবদ্ধ মানুষের আচার-আচরণ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সামাজিক সংগঠন তৈরি হয়েছে। সামাজিক প্রথা, রীতিনীতি, সংস্কার, ধর্মবিশ্বাস প্রভৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যবিধানের জন্য সমাজের বুকে নানা ধরনের সামাজিক সংগঠন তৈরি হয়েছে। যেমন—পরিবার, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান প্রভৃতি। সামাজিক বিবর্তনের পথে সৃষ্টি হয়েছে আর্থিক সংস্থা (Economic Institution), পেশাগত সংস্থা (Professional Institution), রাজনৈতিক সংস্থা (Political Institution) প্রভৃতি। শিক্ষা সামাজিক সংগঠনের হাতিয়ার হয়ে সংগঠনে পরিবর্তন আনছে এবং যথার্থ পথ নির্দেশ করছে। অপরপক্ষে সামাজিক শ্রেণি, কৃষ্টি প্রভৃতি শিক্ষা প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করছে।
4) সামাজিক যোগাযোগ ও শিক্ষা
সামাজিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে যুক্ত শিক্ষা, গণমাধ্যম, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রভৃতি কার্যকরী ভূমিকা পালন করে চলেছে। শিক্ষাপুষ্ট সামাজিক যোগাযোগ সামাজিক পরিবর্তন আনছে। তাই ব্যক্তিসত্তা তথা সমাজসত্তার বিকাশ ঘটাচ্ছে।
5) সামাজিক মনোভাব, সামাজিক স্তরবিন্যাস ও শিক্ষা
অতীতের বর্ণভিত্তিক সমাজে ভিন্ন ভিন্ন গোষ্ঠীতে যে মনোভাব প্রকাশ পেত, বর্তমানে শিক্ষার আলোকে আলোকিত সমাজে সেই সামাজিক মনোভাবের (social attitude) পরিবর্তন ঘটেছে। মানুষ তার আপন জগতে আপন প্রকৃতির পরিবর্তন ঘটিয়েছে) শিক্ষাতত্ত্বের প্রভাবে অতীতের সমাজ সংগঠনের পরিবর্তন হয়েছে, পরিবর্তন হয়েছে অতীতের প্রমবন্টন নীতির (Division of labour) 1 সুতরাং, শিক্ষাতত্ত্ব এবং সমাজতত্ত্বের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক মানবমনে এনে দিয়েছে সচেতনতা, নিয়ন্ত্রণ, মূল্যবোধের ক্ষমতা।
6) সমাজবিজ্ঞান ও শিক্ষার উপাদান পাঠক্রম
বর্তমানে পাঠক্রম (curriculum) নির্ধারণের নীতিগুলো সমাজের চাহিদা, সমাজের উপযোগিতা প্রভৃতিকে ভিত্তি করে গড়ে তোলা হয়েছে। আজকের পাঠক্রম হল বিজ্ঞানসম্মত আগ্রহভিত্তিক, গতিশীল, বাস্তবধর্মী ও জীবনোপযোগী। মাধ্যমিক শিক্ষা কমিশন, মুদালিয়র কমিশন, 1952 1953)-এর মতে সেসব মৌলিক নীতি অবলম্বনে পাঠক্রম রচনা করা উচিত, তার কয়েকটি হল-
[1] পাঠক্রম হবে বৈচিত্র্যপূর্ণ, শিক্ষার্থীদের মানসিক ক্ষমতা, প্রবণতা অনুযায়ী তা রচিত হবে।
[2] সামাজিক পরিবেশ এবং সামাজিক চাহিদা অনুযায়ী পাঠক্রম রচিত হবে।
[3] পাঠক্রমে সাধারণ শিক্ষামূলক বিষয়গুলো ছাড়া অবসর বিনোদনমূলক কার্যাবলি অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
সুতরাং, পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত বিষয়গুলো শিক্ষার্থীদের সামাজজীবনের উপযোগী করে তুলবে। সুতরাং, পাঠক্রম ও সমাজবিজ্ঞানের মধ্যে সম্পর্ক ধনাত্মক ।
7) সমাজবিজ্ঞান ও মানবীয় সম্পর্ক
শিক্ষার্থীদের মধ্যে উন্নত মানবীয় গুণাবলি শিক্ষণ-শিখন প্রক্রিয়াকে ফলপ্রসূ করে। উন্নত মানবীয় সম্পর্কের ভিতে গড়া বৈশিষ্ট্যাবলি বা প্রকৃতি উন্নত জীবনাদর্শ গঠনে সহায়ক। এই মানবীয় সম্পর্কের (Human relation) প্রকৃতি সমাজবৈজ্ঞানিক কৌশল (sociometric technique)-এর দ্বারা নির্ধারিত হয়ে থাকে।
8) সমাজবিজ্ঞান ও শিক্ষার উপাদান
শিক্ষালয় বর্তমানে শিক্ষালয়কে সমাজের একটি ক্ষুদ্র সংস্করণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ John Dewey শিক্ষালয়ের প্রকৃতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে বলেছেন, “school is a purified, simplified and better balanced society.” অর্থাৎ শিক্ষালয় হল একটি পবিত্র, সরল এবং অপেক্ষাকৃত সামঞ্জস্যপূর্ণ সমাজ। এই শিক্ষালয় শিক্ষার্থীদের সামাজিকীকরণে (socialization) সহায়তা করে। এই শিক্ষালয়, বর্তমান রীতিনীতি, কৃষ্টির সঙ্গে অতীতের রীতিনীতি, কৃষ্টিকে সংরক্ষিত করে এবং বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে সেগুলোকে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সঞ্চালিত করে। সুতরাং শিক্ষালয় সমাজের ক্ষুদ্র সংস্করণ হিসেবে অতীতের সঙ্গে বর্তমানের সেতুবন্ধন রচনা করে। প্রথাগত শিক্ষার (Formal education) প্রতিষ্ঠান ছাড়াও অন্যান্য কিছু প্রতিষ্ঠান যেমন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান (Religious Institution), শিক্ষার সংস্থা (Agency of Education) প্রভৃতি শিক্ষা সংস্থার স্বীকৃতি পেয়েছে। সুতরাং, শিক্ষালয়ের অবদানে সমাজবিজ্ঞান (sociology) সমৃদ্ধ হচ্ছে ।
9) সমাজবিদ্যা ও শিক্ষক
বর্তমানে শিক্ষকের বৈশিষ্ট্যাবলি সমাজতত্ত্বে গতি এনেছে। শিক্ষক সমাজতত্ত্বের রীতিনীতিগুলোকে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সঞ্চালিত করে চলেছেন। শিক্ষকই শিক্ষার্থীদের উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত সামাজিক সংস্কৃতির মূল্যায়ন করে সামাজিক মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের পরিচালিত করে চলেছেন। সমাজবিজ্ঞানের তথ্য ও তত্ত্ব নিয়ে আজ শিক্ষকসমাজ প্রগতির পতাকা হাতে নিয়ে মানবসমাজের ভিত শক্ত করে চলেছেন। তাই শিক্ষাগত সমাজবিজ্ঞানী ব্রাউন, শিক্ষক সম্বন্ধে বলেছেন, “(He) must know and evaluate the cultural heritage of students, (he) must record and guide behaviour in social interaction”
10) সমাজবিজ্ঞান ও ভারতীয় শিক্ষাকমিশন (1964-66)
কোঠারি কমিশনের রিপোর্টে বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা যেমন অসাম্য, দারিদ্র্য, মানব সম্পদ, প্রাকৃতিক সম্পদের অপচয় প্রভৃতি দূরীকরণে শিক্ষাকে হাতিয়ার করা হয়েছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিভিত্তিক শিক্ষাই আর্থসামাজিক অবস্থার বিশ্লেষণ করে, সমাজ পুনর্গঠনে সহায়তা করে, সমাজতত্ত্বের রূপান্তর ঘটায়। তাই কোঠারি কমিশনের রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, “The destiny of India is being shaped in her classrooms”
11) সমাজতত্ত্ব ও শিক্ষা – ডেলরস্ কমিশন
1993 খ্রিস্টাব্দের প্রথম দিকে ফ্রান্সের প্রাক্তন অর্থনীতি ও রাজস্ব বিষয়ক মন্ত্রী Jean Jacques Deleres এর সভাপতিত্বে “The International Commission on Education for the 21st century” গঠিত হয়। উত্ত কমিশন বহু পরীক্ষানিরীক্ষার পর 1996 খ্রিস্টাব্দে যে প্রতিবেদন উপস্থাপিত করে, তাকে বলা হয় Learning the Treasure Within”। সেখানে শিখনের যে চারটি স্তম্ভের (Four Pillars) কথা উল্লেখ আছে, সেগুলি হল— [1] জ্ঞানার্জনের জন্য লিখন ( Learning to know) [2] কর্ম সম্পাদনের জন্য লিখন, (Learning to do); [3] একত্রে মিলেমিশে বসবাসের জন্য শিখন, (Learning to live together); [4] মানুষ তৈরির জন্য শিখন, (Learning to be) ।
কমিশনের রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, শিক্ষার মাধ্যমে সামাজিক অসাম্য দূর করে ব্যক্তিসত্তা তথা সমাজসত্তা বিকাশের কথা। চতুর্থ বিষয়টিতে দেওয়া হয়েছে, ব্যক্তি বিকাশের মধ্য দিয়ে আদর্শ সমাজ গঠনের প্রতিশ্রুতি | শিক্ষাই সমাজকে যোগ্য, সুব্যক্তিত্বসম্পন্ন ব্যক্তি উপহার দিতে পারে। আবার, সমাজের ক্ষুদ্রতা, সমাজের অধোগামিতা-দীনতা-অস্থিরতা-অস্বাচ্ছন্দ্য প্রভৃতি দূর করতে শিক্ষার মানবহিতৈষী, সৃজনশীল উপাদানসমূহ বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। সুতরাং শিক্ষার অবদানে সমাজ সমৃদ্ধ হয়, আবার সমাজতত্ত্বের অবদানে শিক্ষাসত্তার উন্মেষ ঘটে।
উপসংহার
শিক্ষা ও সমাজবিজ্ঞানের মধ্যে সম্পর্ক গভীর। সমাজবিজ্ঞানের আত্মসত্তার সঙ্গে শিক্ষাবিজ্ঞানের আত্মসত্তার নিবিড় সম্পর্ক রচিত হয়েছে। সমাজবিজ্ঞানের অনেক অর্থবহ জ্ঞান, কৌশল, সামাজিক কৃষ্টি প্রভৃতি শিক্ষা প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করেছে। অর্থাৎ শিক্ষা ও সমাজবিজ্ঞান একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .