গুপ্তযুগে ভাষা ও সাহিত্য বিশেষ সমাদর লাভ করে। গুপ্ত সম্রাটদের প্রশস্তিগুলি এক বিশেষ ধরনের ছন্দে লেখা হত, যাকে কাব্য বলা হয়। এটি সংস্কৃত ভাষায় রচিত সাহিত্যের এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
বাণভট্টের ‘হর্ষচরিত’ ঐতিহাসিক দিক থেকে কতটা প্রাসঙ্গিক
হরিষেণের এলাহাবাদ প্রশস্তি এর একটি সুন্দর দৃষ্টান্ত। এই সময় চৈনিক পরিব্রাজক ফাহিয়েন (ফাসিয়েন) ভারতবর্ষে আসেন এবং তাঁর ভারত পরিক্রমার বিবরণ তাঁর রচিত গ্রন্থ ফু-কুয়ো-কিং (Fu-Kuo-King)-এ রেখে যান।
ফাহিয়েন বৌদ্ধ ধর্ম ও সাংস্কৃতিক পীঠস্থানগুলি সম্বন্ধে বিশেষ আগ্রহী ছিলেন। তবে তাঁর গ্রন্থে তৎকালীন সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির উল্লেখ আছে। ভারতবর্ষের ইতিহাসের সামাজিক পর্বের অবসান ঘটে সম্রাট হর্ষবর্ধনের রাজত্বকালে। বাণভট্টের ‘হর্ষচরিত’ ঐতিহাসিক দিক থেকে প্রাসঙ্গিক ছিল হর্ষবর্ধনকে সকল উত্তরপথনাথ (Sakalauttarapatanatha) বলে অভিহিত করা হয়। এই উপাধি অবশ্য ঐতিহাসিক দিক থেকে বিতর্কিত কারণ, সমগ্র উত্তর ভারত হর্ষবর্ধনের সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল না। যা হোক, হর্ষবর্ধন-এর রাজত্বকাল ছিল ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে তাৎপর্যপূর্ণ।
হর্ষবর্ধনের সভাকবি বাণভট্টের দ্বারা রচিত হর্ষচরিত হর্ষবর্ধনের রাজত্বকালের সামগ্রিক চিত্র তুলে ধরে। কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে বাণভট্টের রচনায় আতিশয্য আছে এবং তাঁর অতিশয়োক্তিপূর্ণ আখ্যানগুলি হর্ষের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট। কিন্তু এই কথা সর্বদা মনে রাখা প্রয়োজন যে, তৎকালীন সময়ে ‘নিরপেক্ষতা’ শব্দটি ছিল অধিকাংশ ক্ষেত্রে অজানা এবং রাজাশ্রিত সভাকবিরা তাঁদের পৃষ্ঠপোষকদের প্রশংসা করবেন, এতে আশ্চর্যের কিছু নেই।
বাণভট্ট তাঁর যুগধর্ম মাত্র পালন করেছেন। রাজা ও সম্রাটদের দেবতুল্য মনে করা হত। অশোক নিজেকে দেবনম্পিয়দর্শী (Beloved of the Gods) বলে আখ্যায়িত করেছেন এবং স্বমহিমায় সিংহাসনে বিরাজ করেছেন। এই নিয়ে কোনো প্রশ্নের এবং সংশয়ের অবকাশ নেই। কাদম্বরী বাণভট্টের আর একটি উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি। হর্ষবর্ধন নিজে সুশাসক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একজন লেখক ছিলেন। তাঁর রচিত তিনটি নাটক – নাগানন্দ, রত্নাবলি ও প্রিয়দর্শিকা ইতিহাসের মূল্যবান উপাদান। হর্ষবর্ধনের রাজত্বকালে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হল ভারতে চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙের আগমন। তিনি চিন দেশ থেকে অনেক দুর্গম পথ পেরিয়ে আনুমানিক 630 খ্রিস্টাব্দে ভারতবর্ষের গান্ধার প্রদেশে প্রবেশ করেন। হিউয়েন সাঙ (সুয়াং জাং) সম্রাট হর্ষবর্ধনের আতিথ্য লাভ করেন এবং এই দেশে 15 বছর অতিবাহিত করেন।
সি-ইউ-কি (Si-Yu-Kyi) অর্থাৎ, পশ্চিমি দেশের উপাখ্যান তাঁর অনবদ্য কীর্তি। এই গ্রন্থে হিউয়েন সাঙ ভারতবর্ষ সম্বন্ধে তাঁর সমস্ত অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করেছেন। হর্ষবর্ধনের প্রশাসনিক কার্যকলাপ সম্পর্কে এটি একটি প্রামাণ্য গ্রন্থ। ভারতবর্ষে থাকাকালীন হিউয়েন সাঙ নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষানবিশি করেন ও তার পঠনপাঠনের বিশদ বিবরণ দেন। নালন্দায় 10,000 ছাত্র পড়াশোনা করতেন এবং 1,500 অধ্যাপক তাদের জ্ঞানস্পৃহা চরিতার্থ করতেন।
বিদেশি ছাত্ররাও এখানে বিভিন্ন বিষয়ে পাঠ নিতে আসতেন। হর্ষবর্ধন চিন দেশের সঙ্গে দৌত্য (Embassy) আদানপ্রদান করেন। এর থেকে স্পষ্ট যে, হর্ষবর্ধনের রাজত্বকালে ভারত-চিন সম্পর্ক যথেষ্ট বন্ধুত্বপূর্ণ ছিল। হর্ষবর্ধনের মৃত্যুর পরবর্তীকালে ভারতের সামাজিক ঐক্য লুপ্ত হয় এবং আঞ্চলিক রাজ্যগুলি (পাল, প্রতিহার, রাষ্ট্রকূট) পারস্পরিক দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়ে নিজেদের শক্তি বিনষ্ট করে যা ভারতবর্ষের স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ণ করে।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .