সামাজিক পরিবর্তন (social change) সর্বজনীন। কিন্তু সমাজরূপ বিশাল ও জটিল সংগঠনের বুকে সামাজিক পরিবর্তন সাধারণত স্বতঃস্ফূর্তভাবে আসে না, কিছু সুগম, কিছু দুর্গম পথ অতিক্রমের শেষে তা দেখতে পাওয়া যায়। যেমন সতীদাহ প্রথা, বাল্যবিবাহ, অস্পৃশ্যতা প্রভৃতির মতো অমানবিক প্রথা, রক্ষণশীল সমাজের বুক থেকে একেবারে দূর না হলেও বহু মানুষের ত্যাগে, ঐকান্তিক চেষ্টায় ওগুলো অনেকটাই দূর হয়েছে।
ভারতের সামাজিক পরিবর্তনের সমস্যা
রক্ষণশীল মনোভাব
পুরোনো প্রথাকে ধরে রাখার মানসিকতাই সামাজিক সমস্যা দূর করার ক্ষেতে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেছে। এই রক্ষণশীল মনোভাবকে কাটিয়ে সামাজিক পরিবর্তন আনতে বহু সংগ্রাম, বহু ত্যাগের সাক্ষী হয়ে দাঁড়াতে হয়েছে বা হচ্ছে।
অজ্ঞতা
আমাদের ভারতবর্ষের বহু মানুষ নিরক্ষর। নিরক্ষরতার অভিশাপে অভিশপ্ত জীবন অজ্ঞতার অন্ধকারে ডুবে থাকে। তাই সমাজের বুকে বাসা বাধা সমস্যাদি দূর করে, যথার্থ মূল্যবোধের জাগরণ ঘটিয়ে সামাজিক পরিবর্তন আনা কষ্টস্বাধ্য ও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।
সুদীর্ঘদিনের অভ্যাস
সুদীর্ঘকালের যেসব অভ্যাস, যেসব রীতিনীতি, সংস্কৃতি প্রভৃতি সমাজের বুকে বহমান, যেগুলো মানুষের প্রকৃতিতে পরিণত হয়েছে, যেগুলো মানুষকে দাসে পরিণত করে রেখেছে, সেগুলো ছেড়ে নতুনকে গ্রহণ করতে মানুষ চায় না। সুতরাং দীর্ঘদিনের অভ্যাস, সামাজিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ঐতিহ্যবাহী অতীতের প্রতি আকর্ষণ
অতীতের ঐতিহ্যবাহী রীতিনীতি, অভ্যাস, আচার, বিশ্বাস প্রভৃতির প্রতি মানুষ সংবেদনশীল। এই সংবেদনশীলতার জন্য মানুষ অতীতকে ধরে রাখতে চায়, অতীতের ধারায় সে যেন সিও হতে চায়। লাভ বা ক্ষতির ঊর্ধ্বে নিজেকে রেখে খারাপকেও বরণ করে নিতে চায়। তাই ভারতের প্রবহমান স্রোতে বিদ্যমান এই আবেগপ্রবণতা সামাজিক পরিবর্তনে সমস্যার সৃষ্টি করেছে।
বৌদ্ধিক-গ্রাক্ষোস্তিক-সামাজিক প্রভৃতির বিকাশে দীনতা
বৌদ্ধিক প্রাক্ষোভিক-সামাজিক প্রভৃতি ক্ষেত্রে যথার্থ বিকাশের দীনতাবশত প্রগতিশীল নতুন নতুন চিন্তাভাবনাকে গ্রহণ করার মানসিকতার অভাব মানুষের মধ্যে পরিলক্ষিত হচ্ছে। ফলে ভারতবর্ষে সামাজিক পরিবর্তনে সমস্যার সৃষ্টি করেছে।
অর্থনৈতিক বৈষম্য ও দারিদ্র্যজনিত সামাজিক অবস্থান
ভারতে অর্থনৈতিক বৈষম্য ও দারিদ্রাজনিত সামাজিক অবস্থান সামাজিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে সমস্যা সৃষ্টি করছে। অর্থনৈতিকভাবে দুর্দশাগ্রস্ত মানুষ সামাজিক পরিবর্তনে ভয় পায়, সন্দেহ করে, পরিবর্তনের সুফল বোঝে না। তাই অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং দারিদ্রাজনিত সামাজিক অবস্থান সামাজিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অস্বীকার করার মানসিকতা
নতুন উদ্ভাবনকে বরণ করার মানসিকতা বা প্রবণতা মানুষের মধ্যে সাধারণত থাকে না। প্রাথমিকভাবে এই বাধা বিশেষভাবে দেখা দিয়ে থাকে। এই প্রবণতাবশত এই গ্রহের মানুষ গ্রহ নক্ষত্র সম্পর্কিত তত্ত্বকে প্রাথমিকভাবে মেনে নিতে পারেনি। তাই এই অস্বীকার করার প্রবণতা বা মানসিকতা সামাজিক পরিবর্তনে (social change) বাধার সৃষ্টি করে।
নতুন উদ্ভাবনে সীমাবদ্ধতা
নতুন উদ্ভাবন একেবারেই যে সর্বক্ষেত্রে ত্রুটিযুক্ত হবে তা একবাক্যে স্বীকার করা যায় না। ত্রুটি ধরা পড়লে তা পরবর্তী ক্রমে বা ক্রমান্বয়ে সংশোধন করা হয়। নতুন উদ্ভাবনের এই সীমাবদ্ধতার দরুন মানুষ নতুন উদ্ভাবনকে সহজে মেনে নিতে চায় না, ফলে সামাজিক পরিবর্তনের সমস্যার জায়গা তৈরি হয়।
কায়েমি স্বার্থ
দীর্ঘকাল যাবৎ চলে আসা স্বার্থ অর্থাৎ কায়েমি স্বার্থ সামাজিক পরিবর্তনে বাধার সৃষ্টি করে। সাধারণত শিক্ষা-দীক্ষা সংস্কৃতির দিক থেকে কম আলোকপ্রাপ্ত সমাজের মধ্যে অরূপ মানসিকতা বিশেষ করে দেখা দেয়। স্বার্থসিদ্ধির এই মানসিকতা সমাজে নতুন উদ্ভাবনা ও পরিবর্তনের পথ রুদ্ধ করে ফলে সামাজিক পরিবর্তন সমস্যার বাধাপ্রাপ্ত হয়।
দ্বিধাদ্বন্দ্ব-আশঙ্কা-সন্দেহ-ভীতি
পুরাতনকে বর্জন করে নতুনকে গ্রহণ করতে মানব মনে আসে দ্বিধা দ্বন্দ্ব-আশঙ্কা-সন্দেহ-ভীতি প্রভৃতি। এ সবের মূলে থাকে অর্থনীতি, রাজনীতি, সামাজিক বৈষম্য প্রভৃতি। তাই ওগুলোই সামাজিক পরিবর্তনে সমস্যার ক্ষেত্র তৈরি করে।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .