মুসোলিনীর অভ্যন্তরীণ নীতি
ফ্যাসিস্ট প্রাধান্য
১৯২২ খ্রিস্টাব্দে প্রধানমন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত হয়ে মুসোলিনী ইতালীতে ফ্যাসিস্ট একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হন। বিরোধী দলগুলির ওপর নানা ধরনের অত্যাচার ও দমন-পীড় চলতে থাকে। বিরোধী নেতৃবৃন্দকে কারারুদ্ধ বা হত্যা করা হয়। এইভাবে সব রকম ফ্যাসিস্ট বিরোধিতার পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়।
১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে ইতালীতে যে সাধারণ নির্বাচন হয় তাতে গুণ্ডামি ও সমাজতন্ত্রী নেতা গিয়াকোমে মাত্তেওতি-র হত্যাকাণ্ডের পর ইতালীর ‘সংসদে ফ্যাসিস্টদের একাধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে যে নতুন সংবিধান প্রবর্তিত হয়, তার দ্বারা ইতালীতে অন্যান্য দল নিষিদ্ধ করে একদলীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তিত হয় এবং ইতালীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে ফ্যাসিস্ট দলের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। মুসোলিনী ‘ইল-ডুচে’ বা একনায়ক উপাধি ধারণ করেন।
ফ্যাসিস্ট প্রশাসন
(১) একেবারে গ্রাম থেকে শুরু করে প্রশাসনের সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত ফ্যাসিস্ট দলের নিয়ন্ত্রণাধীনে আনা হয়। প্রশাসনের শীর্ষে ছিলেন ‘ইল-ডুচে’ বা মুসোলিনী স্বয়ং। তিনি সমস্ত ক্ষমতা করায়ত্ত করেন এবং রাজা তৃতীয় ভিক্টর ইমান্যুয়েল দেশের আলংকারিক প্রধা েপরিণত হন।
(২) ২০ জন বিশিষ্ট ফ্যাসিস্ট নেতাকে নিয়ে গঠিত হয় এই দলের কেন্দ্রীয় কমিটি—‘ফ্যাসিস্ট গ্রান্ড কাউন্সিল’। মুসোলিনী ছিলেন তার স্থায়ী সভাপতি।
(৩) সরকারি, আধা-সরকারি—সমস্ত চাকরি এংব সেনাবাহিনীতে কেবল ফ্যাসিস্টদেরই নিয়োগ করা হত। ফ্যাসিবাদ-বিরোধী সরকারি কর্মচারীদের বরখাস্ত করা হয়।
(৪) বাক্-স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও সভা সমিতির স্বাধীনতা খর্ব করা হয় এবং ফ্যাসিবাদী সংবাদপত্র ব্যতীত সব সংবাদপত্রের প্রকাশনা বন্ধ করা হয়। ফ্যাসি-বিরোধী সব সংগঠন নিষিদ্ধ হয়। ফ্যাসিস্ট দলের বিরোধিতাকে ‘রাষ্ট্রদ্রোহিতা বলে গণ্য করা হত।
(৫) স্বায়ত্তশাসনমূলক সব প্রতিষ্ঠানে জনগণের ভূমিকা বাতিল করা হয় এবং জনপ্রতিনিধিত্বমূলক সব নির্বাচন বাতিল করা হয়। রোমে অবস্থানকারী ‘পোডেস্টাস’ নামক একশ্রেণীর কর্মচারীর হাতে পৌর-প্রতিষ্ঠানগুলির দায়িত্বভার অর্পিত হয়। মুসোলিনীর লক্ষ্য ছিল সমস্ত বিষয়ে রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব স্থাপন—রাষ্ট্রই হবে সকল ক্ষমতার আধার, উৎস ও অধিকারী। বলা বাহুল্য, রাষ্ট্র বলতে মুসোলিনী বুঝতেন নিজেকে ও তাঁর দলকে।
শ্রমিক ও শিল্পনীতি
মুসোলিনীর লক্ষ্য ছিল সকলের সহযোগিতায় ইতালীকে একটি ‘কর্পোরেট রাষ্ট্র’ (যৌথ রাষ্ট্র) হিসেবে গড়ে তোলা। এই উদ্দেশ্য (১) ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে এক আইন দ্বারা তিনি ১৩টি সিন্ডিকেট বা কর্পোরেশন গঠন করেন। এগুলির মধ্যে ৬টি ছিল মালিকশ্রেণীর, ৬টি শ্রমিকশ্রেণীর এবং ১টি ছিল বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে গঠিত। এই ১৩টি সিন্ডিকেটই মুসোলিনীর নির্দেশ অনুসারে চলত। (২) ট্রেড ইউনিয়নগুলি ভেঙে দিয়ে শ্রমিক আদালত গঠন করা হয়। এখানে শ্রমিক-মালিক বিবাদের নিষ্পত্তি করা হত। কারখানায় ধর্মঘট, লক্ আউট প্রভৃতি, নিষিদ্ধ ছিল। (৩) শ্রমিক ও মালিকদের সিন্ডিকেটগুলি শিল্প-সংক্রান্ত বিভিন্ন নীতি, মজুরির হার, আমদানি-রপ্তানি নীতি প্রভৃতি স্থির করত।
কৃষি ও শিল্প
তিনি দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির দিকে নজর দেন। তিনি কৃষিকাজে উৎসাহ প্রদান করেন এবং তাঁর আগ্রহে বহু অনাবাদী জমি চাষের অধীনে আনা হয়। জলপাই ও অন্যান্য ফলের চাষ কমিয়ে দিয়ে গম উৎপাদনের দিকে বিশেষ নজর দেওয়া হয়। মুসোলিনী একে ‘গমের যুদ্ধ’ বলেছেন। গমের পর অন্যান্য শস্যের উৎপাদন বৃদ্ধির দিকেও নজর দেওয়া হয়। এইভাবে ইতালী খাদ্যের স্বয়ম্ভর হয়ে ওঠে এবং বিদেশ থেকে খাদ্য আমদানি হ্রাস পায়। অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও বেকার সমস্যার সমাধানকল্পে মুসোলিনী বেশ কিছু হাসপাতাল, সেতু, রাস্তাঘাট ও রেলপথ নির্মাণ এবং জলাজমি উদ্ধার প্রভৃতির ব্যবস্থা করেন। তাঁর উদ্যোগে দেশে জাহাজ নির্মাণ, বিমান নির্মাণ, বেতার, বিদ্যুৎ, মোটরগাড়ি, সিল্ক প্রভৃতি শিল্পের ব্যাপক উন্নতি ঘটে। ইতালীয় পণ্য বিদেশে রপ্তানি হতে থাকে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে একটি কেন্দ্রীভূত ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে ‘ফ্যাসিস্ট সিন্ডিক্যালিজম’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গঠিত হয়।
শিক্ষা
মুসোলিনী শিক্ষা বিস্তারের দিকে যথেষ্ট গুরুত্ব আরোপ করেন। তাঁর উদ্যোগে দেশে বহু বিদ্যালয় গড়ে ওঠে। তাঁর শিক্ষানীতির মূল লক্ষ্য ছিল ফ্যাসিবাদী ভাবধারার প্রতি অনুগত নাগরিক তৈরি করা। এই উদ্দেশ্য নিয়েই বিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তকগুলি রচিত হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে ফ্যাসিস্ট ছাড়া অপর কাউকে নিয়োগ হত না। শিক্ষায়তনগুলিতে মুসোলিনীর ছবি টাঙিয়ে রাখা ধতামূলক ছিল।
জনসংখ্যা বৃদ্ধি
জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ নয়—মুসোলিনী চাইতেন জনসংখ্যা বৃদ্ধি। যুদ্ধজয়ের জন্য বিশাল সেনা-বাহিনীর প্রয়োজন। তাই মুসোলিনী জনসংখ্যা বৃদ্ধি চাইতেন। এই কারণে সরকার থেকে বাল্যবিবাহ, বৃহৎ পরিবার এবং অধিক সংখ্যক সন্তানের জননীদের উৎসাহ দান করা হত।
পোপের সঙ্গে মীমাংসা
দীর্ঘদিনের বিবাদ মিটিয়ে নিয়ে পোপের সঙ্গে সমঝোতা স্থাপন মুসোলিনীর অন্যতম কৃতিত্ব। গীর্জার সাহায্যে জনসাধারণের ওপর প্রভাব বিস্তারের উদ্দেশ্যে তিনি ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে পোপের সঙ্গে ল্যাটেরান চুক্তি সম্পাদন করেন। এই চুক্তি অনুসারে রোমান ক্যাথলিক ধর্ম রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে এবং রোমের ভ্যাটিকান নগরীকে সার্বভৌম রাষ্ট্রের মর্যাদা দেওয়া হয়।
অপরপক্ষে, পোপ স্যাভয় বংশের অধীনস্থ ইতালী রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেন। এইভাবে মুসোলিনী ধর্মভীরু ইতালীয়দের সমর্থন লাভ করে নিজ রাজনৈতিক প্রতিপত্তি সুদৃঢ় করেন।
সমালোচনা : মুসোলিনীর একনায়কতন্ত্র ও অভ্যন্তরীণ নীতিকে কোনভাবেই সমর্থন করা যায় না। (১) তাঁর শাসনাধীনে ব্যক্তি-স্বাধীনতা, নাগরিক অধিকার সব কিছু পদদলিত হয়, যা কোনভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। (২) তাঁর শাসনাধীনে জনগণের আর্থিক অবস্তার কোন উন্নতি হয়নি— শ্রমিকদের মজুরি ছিল কম, পরিশ্রম ছিল অনেক বেশি, কিন্তু শাস্তির ভয়ে তারা কিছু বলতে পারত না। (৩) মুসোলিনী জলপাই ও অন্যান্য ফলের চাষ কমিয়ে গমের চাষ বাড়াতে সচেষ্ট হন। তাই যে-জমিতে জলপাই ফলে সেখানে জোর করে গমের চাষ করাতে গিয়ে জলপাই বা গম কোনটার ফলনই ঠিকমতো হয়নি। (৪) তিনি লোকসংখ্যা বৃদ্ধিতে উৎসাহ দিতেন, কিন্তু এই বাড়তি লোকসংখ্যার খাদ্য ও অন্যান্য দ্রব্যাদি যোগান দেওয়া সম্ভব ছিল না। বস্তুত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে ইতালীর অর্থনীতি ভেঙে পড়ে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ দিকে মুসোলিনীর স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে প্রবল গণ-বিক্ষোভ শুরু হয়।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .